কলকাতার সংগীত ভুবন
২১ জুন বিশ্ব সংগীত দিবস। এ উপলক্ষে কলকাতায় বসছে গানের আসর। শুধু কি একটি দিনের উদযাপন, সারেগামায় সারা বছর ডুবে থাকে এই প্রাচীন শহর। ইতিহাস ও শ্রুতির দর্পণে ধরা থাকে সেই অ্যালবাম।
গান ভালবেসে গান
সংগীতের সফরে কলকাতার ক্লান্তি নেই। বছরভর সপ্তসুরে মেতে থাকে শহর। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোক বা উৎসবের মঞ্চ, রাজনৈতিক কর্মসূচি কিংবা বিয়ের বাসর, গান ভালবেসে গান শহরবাসী। এই উদযাপনের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল।
পথ চলিতে যদি চকিতে
সংগীত যেখানে বারোমাসের পার্বণ, তার শ্রোতার সংখ্যাও বিপুল। ইয়ারপ্লাগ কানে গুঁজে গুনগুন করতে করতে পথ হাঁটে কলকাতা। আবার রাস্তার ধারে পুরোনো রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডির পশরা দেখে থমকে দাঁড়ায়।
হে অতীত কথা কও
যশোর রোডের ধারে এই প্রাচীরের গায়ে সময়ই থমকে আছে। বিবর্ণ রেখায় ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ (এইচএমভি) শুধুই ইতিহাস। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই রেকর্ডিং স্টুডিওয় আর গান বাজে না। আট দশকের সেই যাত্রার স্মৃতি তুলে আনেন লোকশিল্পী শুভেন্দু মাইতি। ডিডাব্লিউ-কে বলেন, ‘‘পুজোর আগে আমরা ওখানে ভিড় করতাম। যদি একটু নতুন গান শোনা যায়!‘‘
প্রযুক্তির বিপ্লব
‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন’– এমনই ছিল বিজ্ঞাপনের ভাষা। আজ গ্রামোফোন রেকর্ডের ঠাঁই হয়েছে জাদুঘরে। গান বন্দি মুঠোফোন ও অনলাইন অ্যাপে। কোনো কোনো দোকানে এখনো সাজানো থরে থরে রেকর্ড। কদাচিৎ উৎসুক ক্রেতার নজর পড়ে তাতে।
প্রাণে গান নাই
কলকাতায় সংগীতের সদর দপ্তর ছিল ধর্মতলার এম বিশ্বাস অ্যান্ড সিম্ফনি। বদলে গিয়েছে তার ব্যবসার প্রকৃতি। এখন প্রথমেই চোখ টানে কড়া, ফ্রাই প্যান, প্রেশার কুকার ও হরেক বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম। কর্ণধার প্রেমকুমার গুপ্তা ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডি এখনও আছে। তবে অন্যান্য সামগ্রীও রাখতে হয়েছে ব্যবসার খাতিরে।’’
গানের সুরের আসনখানি
গত শতকের ষাটের দশকে আসে ক্যাসেট, আশির দশকে কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডি। সেসবের আসন এখন পাতা ফুটপাতে। রোজ বিকেলে কলকাতার ওয়েলিংটন মোড়ে বসেন বিক্রেতারা। গড়িয়ার সুবল নন্দী ফুটপাতে খুঁজছিলেন প্রিয় কোনো শিল্পীকে। ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমার ক্যাসেট প্লেয়ারটা এখনো বাজে। তাই কম দামে পুরনো ক্যাসেট নিয়ে যাই।’’
গ্রামোফোন মিস্ত্রি
ক্যাসেট প্লেয়ার কিংবা রেডিও সারাইয়ের কুশলী কারিগররাও কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছেন! এখনো রয়েছেন কলকাতার গ্রামোফোন মিস্ত্রি মহম্মদ দিলজান। সুরের যন্ত্রে প্রাণ ভরে দেন ৭০ পার করা দিলজান। রবীন্দ্র সরণির এক চিলতে দোকানে বসে ডিডাব্লিউ-কে বলেন, ‘‘আমার নাম শুনে দূরের মানুষজনও আসেন। টুকটাক কাজ থাকে সারা বছর।’’
বাদ্য-বাজনার পাড়া
‘‘দাদা, বেস গিটারটা কমসম করে হবে?’’ ‘‘দোতারা কত থেকে শুরু?’’ এমন নানা প্রশ্নে মুখরিত হয়ে থাকে কলকাতার বাদ্যযন্ত্রের বাজার। লালবাজারের কাছে সার সার দোকানে হারমোনিয়াম-তবলা থেকে পারকাশন-সিন্থেসাইজার, কী নেই!
গানের ইশকুল
শিল্পী থেকে শিক্ষার্থী, সকলেই আসেন বাদ্য বিক্রির বিপণীতে। আর পাড়ার সেই গানের দিদিমণিরা? তারা আড়ালে চলে গিয়েছেন। টিকে আছে বড় বড় গানের স্কুল। প্রাচীন ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিক, বাণীচক্র, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর শ্রুতিনন্দন এগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য।
আকাদেমি থেকে মেলা
সংগীতচর্চাকে উৎসাহ দিতে সরকারি স্তরে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। টালিগঞ্জে গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় কর্মশালার। প্রতি বছর তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে বসে সংগীত মেলা।
গানের গল্প
সংগীতকে ঘিরে যাবতীয় কর্মকাণ্ড অনুসরণ করে তার পরম্পরাকে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত আত্মজীবনী, স্মৃতিকথায় এর চর্চা চলে নিরন্তর। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা গানের পথচলা’ না পড়লেই নয়! স্বর্ণযুগের শেষ প্রতিনিধিদের মধ্যে অন্যতম এই সুরস্রষ্টার জীবনাবসান হয় গত বছর।
নাম আমার কিশোরকুমার
এহেন গানের ভুবনে ভক্তরা তো থাকবেনই! দক্ষিণ কলকাতায় কিশোরকুমারের মূর্তির সামনে তারা ভিড় জমান শিল্পীর জন্মদিন ৪ আগস্টে। মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া থেকে ভারত জয় করেছিলেন তিনি। গেয়েছিলেন, ‘নাম আমার কিশোরকুমার গাঙ্গগুলি, আমি বম্বেবাসী, আজ প্রবাসী, তবু খাঁটি বাঙালি’।
তোমাকে চাই
যাদবপুরের গৌরব গুহের মতো ভক্ত আর কোথায় মেলে! এইট-বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে তার দোকান ‘চা ও নচিকেতা’। শিল্পীর ছবিতে সাজানো দোকান। দিনভর বেজে চলে নীলাঞ্জনা থেকে বৃদ্ধাশ্রম। গৌরব ডিডাব্লিউ-কে বলেন, ‘‘নচিদা নিজে এই দোকানের উদ্বোধন করেন। জন্মদিনে সবাইকে চা-ও খাইয়েছেন।’’
একলা ঘর আমার দেশ
এই বাংলায় খুবই জনপ্রিয় তরুণদের ব্যান্ড আইকন রূপম ইসলাম। তার গানের দল ফসিলস-এর ভক্তরা আছেন বাংলাদেশেও। সাউথ এন্ড পার্কে এলেই অনেকে খোঁজ করেন, ‘‘রূপম কোথায় থাকেন বলতে পারেন?’’ পথিকের প্রশ্নের অবকাশ দূর করে দিয়েছেন শিল্পীর অনুরাগীরা।
সব পথ এসে...
এই সাউথ এন্ড পার্কেই কিন্তু কলকাতার অন্যতম সংগীত তীর্থ। মুম্বই যাওয়ার আগে এখানেই থাকতেন শচীন ও রাহুল দেব বর্মণ। এই বাড়িতে সংগীতের জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। কলকাতা পুরসভা রাস্তাটির নাম পাল্টে রেখেছে সঙ্গীত সরণি।
বাড়ির কাছে আরশিনগর
সংগীতের এই তীর্থ ওপার বাংলাকে ছাড়া সম্পূর্ণতা পায় না। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিন থেকে অর্ণবের গান শুনতে ভরে যায় প্রেক্ষাগৃহ। গত মাসে এসেছিলেন লালনগীতির সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন। গানের ফাঁকে তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় এলে খুব ভালো লাগে। এত সমঝদার শ্রোতা খুব কম জায়গায় মেলে।’’