কলকাতার রেসকোর্স, ঘোড়দৌড় ও রাজকীয় বাজির কাহিনি
এ এক অন্য জগৎ। ময়দানে সবুজ রেসকোর্স, ব্রিটিশ আমলের টার্ফ ক্লাব, আইনসিদ্ধ বেটিং. ঘোড়া, স্বপ্ন ও তা ভঙ্গের কাহিনি।
রেসের মাঠ এখনো প্রাণচঞ্চল
ঘোড়া ছুটছে আর দূরবীনে চোখ লাগিয়ে কাম-অন প্রিন্স অথবা জিও মেরা সুরজ বলে চিৎকার করছেন সুদর্শন চেহারার যুবক। এককালে বহু বাংলা সিনেমায় রেসের মাঠের এমন দৃশ্য দেখেছে সিনেমাপ্রেমীরা। ইদানিং সিনেমায় না দেখা গেলেও কলকাতা রেসের মাঠ কিন্তু ‘টগবগ’ করেই ছুটছে আজও।
অবারিত দ্বার
এককালে শনিবারের পড়ন্ত বিকেলে রেসের রাজকীয় বাজিতে মেতে থাকত কলকাতার বড়লোকেরা। সাহিত্য সিনেমা নভেলে এমন উদাহরণ দেখা গেলেও রেসের ময়দান সর্বজনীন। রাজা ভোজ থেকে গঙ্গুরাম তেলি, পকেটে রেস্ত থাকলে সকলের জন্যই এই দ্যুতোদ্যানের দ্বার অবারিত।
শতবর্ষ পেরনো টার্ফ ক্লাব
রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব, যার জনপ্রিয় নাম আরসিটিসি, স্বাধীন হওয়ার ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ঘোড়দৌড় সংস্থা। প্রথমে রেসকোর্সটি ছিল দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে।
ময়দানে ১৯১৫ থেকে
১৯১৫ সালে টালিগঞ্জ কোর্স বন্ধ হয়ে যায় এবং রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব কলকাতার কেন্দ্রস্থলে ময়দানে স্থানান্তরিত হয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর এই রেসকোর্সের মধ্যে ফারাক মাত্র একটি রাস্তার। হসপিটাল রোড।
১৮৮৭-তে চালু ডার্বি
রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের সমস্ত নিয়ম কানুন আজও ইংরেজ আমলের সাক্ষ্য বয়ে নিয়ে চলে। আদব কায়দা থেকে শুরু করে রেসের নামকরণও ইংরেজদের রেসের নামানুসারে। ১৮৮৭ সালে কলকাতায় ডার্বি শুরু করেছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেরেসফোর্ড।
অন্য জগত, আলাদা উন্মাদনা
কলকাতার রেসকোর্স ভারতের প্রথম এবং বৃহত্তম রেসকোর্স। এক অনন্য জগৎ। কত মানুষ কাজ করছেন, কত উন্মাদনা এই রেসকে ঘিরে। রাজা-মহারাজা ও ব্রিটিশদের এই রাজকীয় জুয়া খেলায় একবার লাগাম টানতে চেয়েছিলেন পশুপ্রেমী লর্ড ওয়েলস্লি। কিন্তু ওই কিছুদিন! তারপর আবার চালু হয়।
পাঁচশ টাকার টিকিট
রেসের মাঠের অনেক নিয়মকানুন। হুট করে চাইলেই যে কোনো জায়গায় ঢোকা যায় না, ছবি তোলা যায় না। আর রেস খেলারও আছে অনেক নিয়ম। শুধুমাত্র মাঠে ঢুকতে গেলেই কাটতে হবে পাঁচশ টাকার টিকিট। খেলার জন্য আলাদা খরচ।
বাজি শুরু দশ টাকা থেকে
দশ টাকা দিয়ে খেলা শুরু করা যায়, তবে ওপরের কোনও সীমা নেই। এই খেলার হিসেব বেশ কঠিন, এক লাইনে বোঝানো সম্ভব নয়।
ঘোড়ার পাসে সহিস
আস্তাবলে থাকা ঘোড়াকে সেবা করেন যারা তাদের বলা হয় সেবক বা সহিস। এরা ঘোড়ার যত্ন নেন। রেসের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এরা ঘোড়ার পাশে থাকেন।
বেতন প্রচুর
ঘোড়ার মালিকেরা প্রচুর বেতন দিয়ে তাদের ঘোড়ার সেবার জন্য সহিস পোষেন। ঘোড়া ভালো থাকলে ছুটবে ভালো, আর ভালো ছুটে রেস জিতলে মালিকের মোটা টাকা রোজগার। কারো কারো ঘোড়া আসে ফ্লাইটে করে। প্রশিক্ষিত সেসব ঘোড়ার দাম শুনলে চোখ কপালে উঠবে।
লাখ টাকার জকিরা
কয়েক কোটি টাকার সেই সব ঘোড়ার জকিদের বেতনও লক্ষাধিক টাকা। আর আছে জকিদের মোটা টাকার বিমা। ঘোড়া থেকে পড়ে যদি কোনো জকি মারা যান, তৎক্ষণাৎ তার পরিবার পেয়ে যান বিমার টাকা।
রেস চলার সময়
রেস চলাকালীন ঘোড়ার সঙ্গে পাশের ট্র্যাকে ঘোরে প্রাইভেট নার্সিংহোমের অ্যাম্বুলেন্স, বিচারকের গাড়ি। কেউ ঘোড়া থেকে পড়ে জখম হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
প্রতিটি রেসের পর
প্রতিটি রেসের পরে হয় পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। একটি রেস জেতার পিছনে ঘোড়ার সক্ষমতা যেমন প্রয়োজন তেমনই দক্ষতা থাকা দরকার ঘোড়ার চালকেরও। তাই পুরষ্কারে সম্মানিত করা হয় ঘোড়ার জকিকে।
অন্য রেসও খেলতে পারেন
কলকাতা ক্লাবে শুধু কলকাতারই যে খেলা হয় তেমনটা নয়। এখানে বসেই অনেকে খেলতে পারেন মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর সহ দেশের অন্যান্য শহরের খেলাও। পোড় খাওয়া খেলোয়াড়েরা এগুলোয় অভ্যস্থ। রেসের মাঠে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢোকা যায় না। তা জমা রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে কেউ যদি একান্তই মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখতে চান, তার জন্য পকেট থেকে দেড়শো টাকা খসাতে হবে। যার বিনিময়ে নিজের কাছে রাখা যাবে ফোনটি।
রেসের বই
রেসের মাঠে অনেকের হাতেই দেখা যায় এই চটি বই। আসলে এই বইটিতে সারাদিনের রেসের বিবরণ দেওয়া থাকে। দিনে কতগুলো রেস হবে, কোন কোন ঘোড়া দৌড়াবে আর কোন ঘোড়সওয়ারই বা রেসে অংশগ্রহণ করবেন, তার সবই এই বইটিতে থাকে। কলকাতার রেসে বাজি ধরা আইনসিদ্ধ।
আছে বোর্ড
রেসে কোন ঘোড়া জিতলো। কোন রেস কখন হবে, তা দেখার জন্য আছে ইলেকট্বনিক বোর্ড।