‘কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই নির্বতনমূলক আইন বাতিল হয় না'
১৮ এপ্রিল ২০২৫
নির্বতনমূলক আইন প্রয়োগ করা হলেই শুরু হয় তুমুল আলোচনা, সমালোচনা৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করে এসব আইন বাতিল করার দাবিও ওঠে তখন৷ কিন্তু দশকের পর দশক পার হলেওআইনগুলো কিন্তু বাতিল বা সংশোধণ করা হয় না৷ নিবর্তনমূলক আইনের নানা দিক নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সিনিয়র আইনজীবী ও মনবাধিকার কর্মী জেড আই খান পান্না।
ডয়চে ভেলে : বাংলাদেশে কোন আইনগুলোকে নির্বতনমূলক বলা হয়?
জেড আই খান পান্না : নির্বতনমূলক আইনগুলোর মধ্যে একটা আছে বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪, আরেকটা হলো সিআরপিসির ৫৪ ধারা, আরেকটা হলো ১৬৭ ধারা, যেটা পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া এবং নির্যাতন করা…। রিমান্ডে নির্যাতনের কোনো আইন নেই, কিন্তু পুলিশ করে৷ এটা সর্বজনস্বীকৃত। এভাবে আমরা তো সর্বত্র নিগৃহীত। আইন থাক আর না থাক, সরকারী কোনো কর্মকর্তার কাছে গেলে, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এটা মনে না করে নিজেদের ‘মাস্টার' মনে করে। কারণ, আমাদের যে আইনগুলো, সেগুলো বৃটিশ আমলের আইন। এই আইনগুলো পরিবর্তন না হলে সব আইনই নিবর্তনমূলক। এখানে মাইট ইজ রাইট। কেউ জমি দখল করলে আইন তার পক্ষে।
এই আইনগুলো মূলত কী কাজে ব্যবহার করা হয়?
এখানে প্রেক্ষাপট দেখতে হবে। সুপার মিউটিনি হয়েছে ১৮৫৭ সালে। সুপার মিউটিনি কন্ট্রোল করার জন্য ১৮৬০ সালে হয় পুলিশ আইন এবং দণ্ডবিধি আইন, যেটাকে বলা হয় পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল। ১৮৬১ সালে হয় পেনাল আইন। একই সঙ্গে তিনটা হাইকোর্ট হয়, একটা কলকাতায়, একটা বোম্বে এবং অপরটি চেন্নাইতে।
এই আইনগুলো বাতিল করা হয় না কেন? বাধা কোথায়?
এটা করবে কারা? করবে রাজনৈতিক দল এবং আমলারা। কিন্তু আমলারা এটার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। এটা না থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো তো তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে না। তখন তো জনগণ সর্বময় ক্ষমতার মালিক হয়। পুলিশ যদি কারো গায়ে হাত তোলে, এর জন্য একটা আইন করেছে ২০১৩ সালে, সেটা নির্বতনমূলক আইন। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের জন্য এটা ইউএন-এর চাপে করেছে। এই আইনে পুলিশ যদি কারো উপর নির্যাতন করে সেটা তদন্ত কে করবে? পুলিশ। এটা কি কিছু হলো? হলো না। মূলত তারা শাসন, শোষণ বজায় রাখতে চায়।
বর্তমান সরকার তো অরাজনৈতিক। তারা কেন এগুলো বাতিলের উদ্যোগ নিচ্ছে না?
অরাজনৈতিক বলা যাবে না, বলতে হবে অদলীয়। ইতিমধ্যে তো একটা দল তাদের হয়ে গেছে। সেই দলের রিপ্রেজেন্ট তো তারা করে। ফলে তাদের অরাজনৈতিক বলা যাবে না। এরা বাতিল করছে না এই কারণে যে, যাদের করার কথা তারাই করেনি, এরা তাহলে কেন করবে? এই সরকার তো জনগণের কাছে দায়বদ্ধ না। এই সরকার তো একটা অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে এসেছে। কিন্তু জনগণের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা কম। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের যে দায়বদ্ধতা, সেটা এই সরকারের নাই। যাদের দায়বদ্ধতা ছিল তারাই এটা ফিল করেনি। কয়েকটি মামলার রেফারেন্স দেই, ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলা। সেকশন ১৫৪ ও ১৬৭-র মামলা আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছে যে, এটা করা যাবে না। প্রথমে হাইকোর্টে হামিদুর রহমান এবং সালমা মাসুদ চৌধুরীর জাজমেন্ট দিয়েছেন, আপিল বিভাগ সেটা গ্রহণ করেছে। এরপর সরকার এসে সেটা রিভিউ করেছে। এর মধ্যে তিনটা সরকার কিন্তু চলে গেছে। এখন এটা কেন করে না? ওই একটা জায়গায় তারা এক, সেটা হলো, তাদের কর্তৃত্ব, শাসন, শোষণ এবং আমলাতন্ত্র যেন বজায় থাকে সেটা তাদের মাথা থেকে বের হয় না।
বর্তমান সরকার তো সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকগুলো কমিশনও কাজ করেছে। কিন্তু বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এগুলো বাতিলের কথা বলেনি, কেন?
আইন উপদেষ্টা কিন্তু প্রকারন্তারে মেঘনা আলমের ঘটনায় একটা জায়গায় বলেছেন, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, কালো আইন। কালো আইন মানে কী? এই যে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট যেটা ছিল, এটা তো অনেকটা নির্বতনমূলক। এখন সেটা থাক আর না থাক, কিন্তু সেই ধরনের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কি আছে? ফলে বুঝতে হবে, একটা জায়গায় আমরা ইন্টারেস্টটা কমন রাখি। আমরা যখন ক্ষমতায় থাকি, তখন আমরা নিজেদের ইন্টারেস্টটার বাইরে যাই না।
এগুলো বাতিল হলে সংশ্লিষ্ট অপরাধ দমনে সরকার কি আইনি শূন্যতায় পড়বে?
মোটেই না। যেমন বৃটেনে পুলিশের হাতে অস্ত্র নেই। সুইজারল্যান্ডেও নেই। ক্রাইম সেখানে নিয়ন্ত্রণ হয়েছে কিভাবে? অস্ত্র দিয়ে? মোটেও না। মোটিভেশনের মাধ্যমে। আমাদের এখানে শাস্তির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু মোটিভেশন নেই। আমরা সব সময় ডাক্তারের কাছে গিয়ে মেডিকেল চেকআপ করি। জেনারেল চেকআপের ভেতরে একবারও সাইকোলজিক্যাল বা সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাই না। আমরা সবাই কম-বেশি সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট বলা যায়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। বিদেশে কিন্তু এটা বাধ্যতামূলক। আমরা দেখতে পাই কি, কারো কাছে অস্ত্র আছে, কারো কাছে অন্য কিছু আছে। মাস্তানি হয়ে গেছে গর্বের ব্যাপার। টোটাল সিস্টেমটাই তো উল্টে গেছে। আগে আমরা একজন শিক্ষককে যে সম্মানটা করতাম, এখন কি সেটা করি? করি না। আগে একজন শিক্ষকের ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্কে আত্মীয়তা করতে আমরা ব্যাকুল থাকতাম। এখন তো এটা পুরো উল্টো। শিক্ষক মানে পয়সাপাতি নেই। সমাজটাই তো গেছে, টাকা দিলেই কেনা যায়।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের কয়েকটি ধারা আছে জনস্বার্থে। সেগুলো প্রয়োগ না করে শুধু ডিটেনশনের ক্ষেত্রে এটা কেন ব্যবহার হয়?
স্মাগলারসহ অন্যদের ব্যাপারে এই আইনের কোনো প্রয়োগ করা হয় না। করলে তো বুঝতাম কিছুটা কমেছে। কারণটা হলো- ইন্টারেস্ট নেই। এটা যারা প্রয়োগ করবে, তারা তো এগুলো করলে পয়সাটা পাবে না। মূলত, আমাদের সোসাইটি, এডুকেশন, মোরালিটি- সবই হয়ে গেছে কমিউনিটিবেজড। আমরা ধরেই নিচ্ছি সবকিছু কেনা যাবে। এই কারণে এই অধঃপতন হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলে থাকলে নির্বতনমূলক আইন বাতিলের দাবি করে। কিন্তু সরকারে গেলেই তারা এটা ভুলে যায়৷ দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্কৃতি চলছে। এ থেকে বের হওয়ার পথ কী?
বের হওয়ার পথ হলো গণতন্ত্র। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র থাকতে হবে। একটা দল দেখান, যাদের মধ্যে গণতন্ত্র আছে। গত বছর দেখলাম সিপিবি ও বাসদের নেতৃত্বে একটা পরিবর্তন আসলো। এটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। প্রত্যেকটা দল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যে দলে গণতন্ত্র নেই, সেই দল জনগণকে গণতন্ত্র দেবে সেটা কি পাগলেও বিশ্বাস করবে? ইতিহাসটা যদি দেখেন, এখানে যারা ছিল, তাদের মধ্যে যতক্ষণ গণতন্ত্র ছিল, ততদিন তাদের মধ্যে নেতৃত্বের পরিবর্তন এসেছে। যখনই দলগুলো গণতন্ত্র হারিয়ে ফেলেছে, তখনই তারা অটোক্রেসিতে পরিণত হয়েছে। যেমন ধরেন, সংবিধানের ৭০ ধারা যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে দেখবেন গণতন্ত্র কিভাবে থাকে। সংবিধানে তো তেমন কিছু নেই। ৭০ ধারা অনুযায়ী দলের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা নেই। দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তাকে বহিস্কার না করা হয়, সদস্যপদ শূন্য না হয়, তাহলেই হবে। এটা অটোমেটিক্যালি হবে না, ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে। নতুন সংবিধানের দরকার নেই। বহুত্ববাদের কথা বলবেন, আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখবেন- এটা তো পাশাপাশি হয় না।