কংগ্রেস নেতার গ্রেপ্তারে কী উদ্দেশ্য শাসকের?
৫ মার্চ ২০২৩কলকাতা হাইকোর্টের তরুণ আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচী রাজ্যের তৃণমূল সরকারের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত৷ শুক্রবার রাত তিনটের সময় তার বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ৷ শনিবার বিকেলে ব্যাঙ্কশাল আদালত কৌস্তভকে জামিনও দেয়৷ এ নিয়ে দিনভর সংবাদ শিরোনামে ছিলেন এই তরুণ কংগ্রেস নেতা৷
শুক্রবার প্রদেশ কংগ্রেস দপ্তরে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন কৌস্তভ৷ সেখানে প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দীপক ঘোষের লেখা একটি বই তুলে ধরেন তিনি৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ওই বইতে যা লেখা হয়েছে তা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন আইনজীবী৷
কৌস্তুভ এই সাংবাদিক বৈঠককে মুখ্যমন্ত্রীর একটি মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন৷ সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের পরেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মন্তব্য করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সেখানে উঠে আসে অধীরের প্রয়াত কন্যার প্রসঙ্গ যার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল৷
মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণের অভিযোগ তুলে কৌস্তভ পাল্টা মমতার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই প্রশ্ন তোলেন দীপক ঘোষকে উদ্ধৃত করে৷ এরপরই শুক্রবার গভীর রাতে কৌস্তভের বাড়িতে যায় পুলিশ৷ রাতভর জিজ্ঞাসাবাদের পর শনিবার সকাল আটটা নাগাদ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
কৌস্তভের বিরুদ্ধে একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করে পুলিশ৷ এর মধ্যে রয়েছে ৩৫৪এ (অশালীন মন্তব্য), ১২০বি (ষড়যন্ত্র), ৫০৬ (ভয় প্রদর্শন), ৫০৪ (শান্তিভঙ্গের উদ্দেশ্যে মিথ্যাভাষণ) প্রভৃতি৷ শনিবার বিকেলে কংগ্রেস নেতাকে ব্যাঙ্কশাল আদালতে পেশ করা হলে বিচারক এক হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন দেন তাকে৷
আদালত থেকে বেরিয়ে নাটকীয়ভাবে নিজের মস্তক মুণ্ডন করেন কৌস্তভ৷ তার পণ, তৃণমূল সরকারকে উৎখাত না করা পর্যন্ত তিনি চুল রাখবেন না! প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কৌস্তভের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘আইনি লড়াই চলবে৷ লড়াই চলবে স্বৈরাচারী তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷''
এই ঘটনায় বিরোধীরা সমস্বরে সরব হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে৷ আদালতে কৌস্তভের হয়ে সওয়াল করা আইনজীবী ও বাম সংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে মাঝরাতে বাড়ি গিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করেছে কৌস্তভকে৷ পশ্চিমবঙ্গে যে গণতন্ত্র নেই এটা তার প্রমাণ৷'' বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও কৌস্তভের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাজ্যের সমালোচনা করেছেন৷
তৃণমূলের মধ্যে এ বিষয়ে ভিন্নমত উঠে এসেছে৷ রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজার বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কৌস্তভ যে কুরুচিকর মন্তব্য করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য৷ অধীর চৌধুরীও অতীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলেছেন৷'' শাসক দলের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন দলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ৷ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘কৌস্তভ অন্যায় করেছেন৷ আমাদের ছাত্রযুবরা এই অসভ্যতা বুঝে নিতে পারত৷ কিন্তু পুলিশের গ্রেপ্তার করা ঠিক হল না''
মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতার মন্তব্যের কেন্দ্রে ছিলেন নারীরাই৷ তাই সব মহল থেকেই উভয়ের মন্তব্যের নিন্দা করা হয়েছে৷ কৌস্তভের দাবি, তৃণমূল নেত্রী অধীরের কাছে ক্ষমা চাইলে তিনিও নিজের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইবেন৷ মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রের বক্তব্য, ‘‘কৌস্তভের কথাকে সমর্থন না করেও বলা যায় তার গ্রেপ্তারি দমনমূলক৷ গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক৷''
এই গ্রেপ্তারিকে কেন্দ্র করে এক দশকের বেশি আগের অম্বিকেশ মহাপাত্রের ঘটনা আলোচনায় উঠে এসেছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন ফরোয়ার্ড করে গ্রেপ্তার হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক৷ আদালতে বেকসুর মুক্তি পাওয়া অধ্যাপক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গোড়া থেকেই রাজ্যকে বিরোধীমুক্ত করতে চেয়েছে এই সরকার৷ তৃণমূল সরকার ও গণতন্ত্র একসঙ্গে থাকবে, এটা হতে পারে না৷''
ঘটনাচক্রে শনিবারই প্রেসিডেন্সি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি৷ তিনিও কৌস্তভের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছেন৷ বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এই গ্রেপ্তারিকে ‘পূর্বপরিকল্পিত' বলে ব্যাখ্যা করেছেন৷ তার মতে, ‘‘নওশাদ-কৌস্তভদের ইচ্ছা করেই প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছে তৃণমূল যাতে বিরোধী ভোট ভাগ করে ক্ষমতায় থাকা যায়৷''
এই সম্ভাবনা একেবারে খারিজ করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শুভময় মৈত্র৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কংগ্রেসের জন্য কিছুটা জমি তৈরির চেষ্টা করছে তৃণমূল, এটা ভাবার অবকাশ আছে৷ নইলে এই গ্রেপ্তারি নিয়ে এত হইচই করার দরকার ছিল না৷ তবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট কেমন ফল করে দেখতে হবে৷''