আছিয়াকে ধর্ষণের যে বীভৎস বর্ণনা ডাক্তার দিয়েছেন, তা শুনে হজম করার মতো শক্ত নার্ভ আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তের নেই৷
কিন্তু এই ধর্ষণ, মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য নতুন কিংবা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়৷ বরং এমন ধর্ষণ বাংলাদেশে হর হামেশা হয়৷ বালিকা থেকে যুবতী, যুবতী থেকে নারী৷ ঘরে কিংবা বাইরে৷ এর কতটা সমাজ সংসার জ্ঞাত হয়, কতটা হয় না৷ বাংলাদেশের মেয়েদের যৌন নিগ্রহ শুরু হয় ঘর থেকে, অতি অল্প বয়সে, নিকটাত্মীয়ের কাছে৷
গবেষণায় এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এলেও এই গার্হস্থ্য যৌন নির্যাতনের অধিকাংশই থেকে যায় অজ্ঞাতে৷ শৈশব কৈশোর থেকেই আমরা আমাদের মেয়েদের শিখাই, এসব প্রকাশ করা লজ্জা৷ এসব প্রকাশ করা লজ্জা, এই ভুল শিক্ষাটি আমরা দেই কখনো সামাজিক মূল্যবোধের কারণে, কখনো বিশ্বাস করে৷ কিন্তু এই ভুল শিক্ষা ঘরে ঘরে আমাদের মেয়েদের স্বাভাবিক দিনাতিপাতের বদলে প্রতিনিয়ত এক আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য করছে৷ মেয়েরা লোকলজ্জার ভয়ে যৌন নিগ্রহের বিষয় প্রকাশ না করে প্রায়শই চেপে যায়৷
এই শিক্ষা যে কতটা ভুল আর কতটা ভয়াবহ তা বোঝার মতো বোধ আমাদের অধিকাংশ অভিভাবকদেরই নেই৷ এই ভুল শিক্ষা ঘরে বাইরে মেয়েদের নিগৃহীত হবার অধিকতর সুযোগ তৈরি করে দেয়৷ এই ভুল শিক্ষা যতটা সামাজিক মূল্যবোধ, গত ততটা বিশ্বাস থেকে৷ নারী পুরুষ নির্বিশেষে বিশ্বাসও করে যে এসব প্রকাশ করা লজ্জা৷
এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছে সমাজের প্রচলিত ট্যাবু থেকে৷ এই সমাজে ধর্ষিতার লজ্জা কেবল নারীর৷ কেবল লজ্জা নয়৷ মাশুলও গুনতে হয় নারীকেই৷ আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে, কোনো না কোনোভাবে সকল দোষ ধর্ষিতার উপর বর্তায়৷ সে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না৷ স্বাভাবিক পারিবারিক কিংবা কর্মজীবন প্রাপ্তি তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়৷ সমাজ সংসার বাঁকা দৃষ্টি ছাড়া তার দিকে আর তাকায় না৷ বেঁচে থেকে সে ভোগ করে এক পতিত দুর্বিসহ জীবন৷ কেননা এই সমাজে নারী নিগৃহীত হলে দোষ পড়ে নারীর ঘাড়েই৷ একঘরে, চরিত্রহীনা ইত্যাদি অপবাদে বিপর্যস্ত হয় নারীর জীবন৷
পুরুষ নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে নারীর উপর চড়াও হতে পারে৷ কখনো টিজিং করে, কখনো নির্যাতক রূপে, কখনো ধর্ষণ করে৷ যে সমাজ ধর্ষিতাকে অস্পৃশ্য করে রাখে, সেই সমাজেই দেখবেন ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়৷ তার না আছে লোকলজ্জার ভয়, না আছে আইনের শাসনের ভয়৷ এমন জঘন্য অপরাধ করেও তার জীবন কোথাও কোনো ভাবেই বাধাগ্রস্ত হয় না৷ না পারিবারিক জীবন, না সামাজিক জীবন, না কর্মজীবন৷ নারীর উপর ঘটে যাওয়া এই অন্যায় তাকে কী পরিমাণ মানসিক এবং সামাজিক ট্রমায় ফেলে তা বলা বাহুল্য৷ এই ট্রমা কাটিয়ে উঠার জন্য তার প্রয়োজন অধিকতর যত্ন, চিকিৎসা, কাউন্সিলিং ও নিরাপত্তা৷ তার বদলে তার জুটে অপবাদ, অপব্যবহার ও অস্পৃশ্যতা৷ আমাদের সমাজের বৃহদাংশের এমনতর মনোভাব ধর্ষণের মতো অপরাধকে পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতাই করে৷
আছিয়ার মৃত্যু হয়েছে৷ আছিয়া প্রথম নয়৷ এর আগে তনু, নুসরাত… খুঁজলে অসংখ্য নাম উঠে আসবে সময়ের পাতা থেকে৷ একেবারে নিকট ইতিহাসের পাতা থেকে৷ তবু এইসময়ে আছিয়া এই সমাজকে তীব্র একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে৷ যে ঝাঁকুনিতে পুরো বাংলাদেশ কাঁপছে, কাঁদছে৷ শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তাল হচ্ছে৷ কিন্তু আমরা যেন অলক্ষ্যে জানি এই কান্নাকাটি, গগনবিদারী শ্লোগান একসময় ঠিক স্তিমিত হয়ে আসবে৷ ক্লান্ত হয়ে পড়বে ধর্ষণের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসা সময়ের সারথীরা৷ আবার ধর্ষিত হবে বালিকা, যুবতী নারী৷ কখনো তার নাম হবে তনু, কখনো পূজা, কখনো পূর্ণিমা, কখনো আছিয়া৷ এই জনপদে ধর্ষণ থামবে না৷ থামবে না ধর্ষণজনিত মৃত্যুর মহামারি৷ আছিয়ার মৃত্যুর পর আরও যে ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে, আছিয়ার বিবাহিত বড় বোন আফিয়াও তার শ্বশুর বাড়িতে গণধর্ষণের শিকার৷ এবং তা প্রতিদিন৷ অর্থনৈতিক অবস্থান ও অসহায়ত্ব নারীদের কী নারকীয় জীবনে ঠেলে দিতে পারে তার প্রমাণ আছিয়া এবং আফিয়া দুই বোন৷
কেন এই সমাজ এবং রাষ্ট্র ধর্ষকদের অভয়ারণ্য? কী এর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় মনস্তত্ব?একি কেবল ব্যক্তির দায়, নাকি সমাজেরও কিছু দায় রয়েছে? রাষ্ট্রেরই বা দায় কতটা?
মানুষ সামাজিক জীব৷ কোনো ব্যক্তি কোনো একক সত্তা হিসাবে গড়ে উঠতে পারে না৷ সমাজ, রাষ্ট্রের কাঠামো তার উপর প্রভাব বিস্তার করে বিপুলভাবে৷ পরিবার এই সমাজ কাঠামো এবং রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে নয়৷
এই সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বড় হওয়া একটি পুরুষের মনস্তত্ত্ব কেমন হয়, যদি তার তল খুঁজতে যাওয়া যায় দেখা যাবে, পরিবার সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কোথাও নারীকে সে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে শিখে না৷ সমাজে নানাদিক থেকে অবরুদ্ধ নারী প্রথমত তার কাছে কৌতূহলের এবং অসম্মানের৷ কারণ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এমন কোনো শিক্ষা নেই যা তাকে নারীকে সম্মান করতে শেখায় কিংবা নারী সম্পর্কে কামনা লালসাহীন সুস্থ মানবিক শিক্ষা দেয়৷ যৌনশিক্ষা কিংবা বয়সের সাথে শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনের কোনো রকম শিক্ষা আমাদের একাডেমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়৷ ফলে একজন নারী বা পুরুষের কোনো উপায় নেই যৌন শিক্ষা পাওয়ার৷ একসময় তাদের ভরসা ছিলো সঙ্গী সাথী, বয়সে বড় কোনো আত্মীয় পরিজন৷ ভুলভাল জেনে বড় হতো প্রজন্ম৷ আর এখন উন্মুক্ত হয়েছে অবাধ প্রযুক্তি, যেখানে কেবল ভুলভাল, বিকৃতি শিক্ষা ছাড়া যৌন সচেতনতা গড়ে উঠার কোনো সুযোগ নেই৷ প্রযুক্তির ব্যবহার যৌন বিনোদনকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়, যা সর্বনাশের সোপান হয়ে উঠেছে৷ অথচ প্রতিটি পরিবারের রয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধ৷ যে যে ধর্মেরই অনুসারী হউক না কেন, ন্যারেটিভস বলে, ধর্ম নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে৷ কোনো ধর্মে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত নির্ধারণ করা হয়েছে৷ কোনো ধর্মে নারীকে দেবীরূপে পূজা করা হচ্ছে৷ সর্বংসহা ধরিত্রী কিংবা দশভুজা, জীবন এবং প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পূজিত হন যিনি, তিনি নারী৷ অথচ আমরা বাস্তবে কী দেখি, পদে পদে নারীর প্রতি সহিংসতা,অসম্মান৷ কখনো মানসিক কখনো শারীরিক৷
মূলত সুস্থ যৌন শিক্ষাহীন প্রজন্ম বিকৃত যৌন বাসনা ও অবদমন নিয়ে বাস করছে৷ ফলশ্রুতিতে সমাজে তৈরি হচ্ছে ধর্ষণ নামের নিরাময়হীন গভীর ক্যানসার৷ আমাদের শিক্ষা এবং সামাজিক ব্যবস্থার অসামঞ্জস্যতায় একজন পুরুষের ধর্ষক হয়ে উঠা খুব বিস্ময়কর কিছু নয়৷ বরং না হওয়াই অস্বাভাবিক৷ নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষাহীন পুরুষ, সংস্পর্শহীন পুরুষ, নারীর প্রতি প্রেমহীন পুরুষ ধর্ষক হয়ে উঠে৷ যৌন অবদমন পুরুষকে ধর্ষক করে তোলে৷ বিকৃত যৌন বাসনাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ৷ এই যে কারণগুলো এর একটার জন্যও নারী দায়ী নয়৷ অথচ এই বিকৃত অসুস্থতার শিকার হয় নারী৷ মাশুল দেয় নারী৷
নারী, বালিকা থেকে প্রৌঢ়া- কেউ ধর্ষণের শিকার হলেই কারণে-অকারণে নারীর পোশাকের দায় উঠে৷ আজ এই প্রশ্ন বোধহয় করাই যায়, আছিয়ার পোশাক কেমন ছিলো? পোশাকের জন্য আছিয়াকে জীবন দিতে হলো কোনো পাগলও বোধহয় এমন কথা বলবে না৷ কেন জীবন দিতে হলো কঠিন পর্দা করা মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে?
ধর্ষণ কিন্তু কেবলই একটি শারীরিক নির্যাতন নয়৷ বিরাট এক মানসিক বিকারগ্রস্থতা৷ জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার ইচ্ছা কোনো শরীরী প্রত্যঙ্গের বিষয় নয়, এটির জন্ম মস্তিস্কে৷ মস্তিস্ক তাকে চালিত করে৷ সেই মস্তিষ্ক সমাজ এবং রাষ্ট্র সৃষ্ট৷ ধর্ষকের শিক্ষা কিংবা রুচি তৈরি হয়নি নিজেকে নিয়ন্ত্রণের৷ নিজেকে সভ্য আর মার্জিত করার শিক্ষা মানুষ মূলত পায় একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা থেকে৷ আর সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে রাষ্ট্রের আনুকুল্যে৷ আমাদের সমাজ রাষ্ট্রে ধর্ষক জানে এই রাষ্ট্রে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক আইনের ফাঁক৷ ধর্ষক জানে এই সমাজে একজন ধর্ষিতাই সবরকম মাশুল দেবে৷ পুরুষটি দেয় না৷ এমনকি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নানা ন্যারেটিভে মেয়েটিকেই দোষী সাব্যস্ত করবে৷ মেয়েটির জীবনই নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত হবে৷ সে থেকে যেতে পারবে ধরাছোঁয়ার বাইরে৷
বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড খুব বেশিদিন আগে নয়, প্রণীত হয়েছে৷ ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী মেয়েটিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর৷ এখনো কোনো ধর্ষকের উপর এই শাস্তি কার্যকর হয়নি৷ বরং ৫ আগস্ট পরবর্তী সহিংসতায় পূজার ধর্ষকের মতো অনেক ধর্ষক জেল থেকে নিরাপদে পালিয়ে গেছে৷
অন্দর ছেড়ে বাইরে বের না হওয়া, কঠিন পর্দা করা, স্বামীর চিতায় ভস্ম হওয়া নারীরা নিজের আত্মমর্যাদা কিংবা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে৷ কোনো ফতোয়াতে তাকে আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না৷ আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না মোরাল পুলিশিং দিয়েও৷ কিন্তু পুরুষদের অধিকাংশ এখনো নারীকে ভোগ্যপণ্যের অধিক কিছু ভাবতে পারে না৷ আমাদের সমাজের পুরুষেরা মেয়েদের এই বহুমুখী অগ্রযাত্রাকে মেনে নেয়ার জন্য জন্য প্রস্তুত নয়৷ শিক্ষা সংস্কৃতিহীন নিম্নবর্গের পুরুষদের মধ্যে এই প্রবণতা এত ভয়াবহ যে নারীর মর্যাদা দূরে থাক, মানুষ হিসাবে স্বতন্ত্র সত্তাই তারা স্বীকার করে না৷
এটা রোধের উপায় কী? কী করে রক্ষা করা যায় আমাদের নারীদের? আইনের কঠিন প্রয়োগ করে? আমার কাছে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ৷ কার্যকরও বটে৷ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিচার সুনিশ্চিত করা যেতে পারে৷ যদি রাষ্ট্র চায়৷ এক দুজন ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সমাজ থেকে এই ক্যানসার নির্মুল করতে পারবে বলে আমি মনে করি না৷ বরং সকল প্রকার নারী নিগ্রহের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই৷
শেষ প্রশ্নটা হতে পারে এ অবস্থা থেকে চিরতরে উত্তরণের উপায় কি? কীভাবে এই জনপদ পুরুষের আক্রমণের ভয়হীন নারীর জন্য নিরাপদ কোনো জনপদ হয়ে উঠতে পারে? সবচেয়ে বেশি দরকার ধর্ষণ করার মতো অসভ্য বর্বর পুরুষকে মানসিকভাবে সুস্থ করে গড়ে তোলা৷ এমন শিক্ষা নিশ্চিত করা যে শিক্ষায় পুরুষ নারীকে সম্মান করতে শিখে৷ পুরুষ, হিংস্র নয় মানবিক মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে৷ কোনো অবোধ বালিকাকে দেখে যেন সে বিকৃত ধর্ষকাম না হয়ে উঠে এমন মানবিক গঠন চাই পুরুষদের৷
আমাদের দেশে আপাতত এই শিক্ষা আদৌ দেয়া সম্ভব কিনা, শুরু করলে সফলতা পেতে কতদিন লাগবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ তাই আপাতত চিৎকার করে বলি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক আর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক৷
সবাই যার যার জায়গা থেকে চিৎকার করি, দাবি জানাই৷ আর সুদূরপ্রসারী আকাঙ্ক্ষা করি এমন এক ব্যবস্থার, যেখানে নারীকে তার প্রকৃত সম্মান দেবার শিক্ষায় মার্জিত হয় পুরুষ৷