আর্থিক অপরাধের বাড়বাড়ন্ত, লাগাম টানবে কে?
১ সেপ্টেম্বর ২০২২এনসিআরবি রিপোর্ট
কোনো প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া। আর্থিক জালিয়াতি কিংবা লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসভঙ্গ। নানা ধরনের আর্থিক অপরাধ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ২০২০ সালের সঙ্গে গত বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনই দাবি ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র। সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে রাজ্যে ছোট-বড় আর্থিক অপরাধের ৮ হাজার ৭০৯টি অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। এটা ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ৭৫০। এর মধ্যে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ ৮ হাজার ৯০৪টি। অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ১ হাজার ৭৬৪টি। মোটের উপর এক বছরে বৃদ্ধির হার ২৩ শতাংশের বেশি। সেখানে জাতীয় স্তরে আর্থিক অপরাধ বেড়েছে ১৬ শতাংশ।
ছোট অঙ্কের জালিয়াতি
রাজ্য রাজনীতি আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে সরগরম বেশ কিছুদিন ধরে। শাসক দলের একাধিক ডাকসাইটে নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিপুল টাকা উদ্ধার হয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে। নেতৃত্বের দুর্নীতি নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে, তখন এনসিআরবি-র রিপোর্টে ধরা পড়ছে, ছোটখাটো আর্থিক অপরাধেরও বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে বঙ্গে। এখানে এক থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রতারণার অভিযোগই সবচেয়ে বেশি। ২০২১-এ ২ হাজার ৪৫১টি এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতারণার সঙ্গে কম অঙ্কের অর্থ যুক্ত রয়েছে। নানা ফন্দিতে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ কোনো প্রলোভনে পা দিয়ে সঞ্চয় খোয়াচ্ছেন। সারদা, রোজভ্যালির মতো বড় মাপের কেলেঙ্কারি পর জনগণ অনেকটাই সচেতন। তাই জালিয়াতির ছোট ছোট চক্র সক্রিয় হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
জাল নোটের কারবার
জাল নোট সংক্রান্ত অপরাধ পশ্চিমবঙ্গে বরাবরই বেশি দেখা যায়। এনসিআরবি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সংক্রান্ত মামলায় এ রাজ্য শীর্ষে। ২০২১ সালে এমন অভিযোগের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে ৮২। অসম ও তামিলনাড়ু রয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে বাংলার সীমান্ত থাকায় এই অপরাধের সংখ্যা বাংলায় বরাবরই বেশি থাকে। তবে ২০১৯ ও ২০২০ সালের তুলনায় জাল নোট সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা বাংলায় কমেছে।
কেন্দ্র-রাজ্যের দায়িত্ব
ব্যুরোর রিপোর্ট ও তথ্য নিয়ে সংশয়ের অবকাশ যে নেই, তা নয়। আইএসআই-এর অধ্যাপক শুভময় মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এ ধরনের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা
নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বরাবরই। তথ্যকে ভুল ব্যাখ্যাও করা হয়।” রিপোর্ট সঠিক ধরে নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, "বামেদের আমলে চিটফান্ডের সূচনা, তৃণমূল রাজত্বে তার রমরমা বেড়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ মানেই আর্থিক প্রতারণার প্রশ্ন আসবে। এই প্রতারণা যতটা কঠোর হাতে মোকাবিলা করার দরকার ছিল, রাজ্য সরকার তা করেছে বলে জনতা মনে করছে না। উল্টোদিকে কেন্দ্রীয় সরকারও স্বল্প সঞ্চয়কে উৎসাহিত করেননি। ডাকঘরে সঞ্চয় কমে গিয়েছে। সুবিধা হয়েছে প্রতারকদের।”
সর্ষের মধ্যে ভূত!
প্রতারণা-জালিয়াতি রোখার ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস ড. নজরুল ইসলাম। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাজ্য সরকার প্রশ্রয় দিচ্ছে দুর্নীতিতে। তোলাবাজি, কাটমানি ছাড়া কাজ হয় না। যে পরীক্ষায় বসেনি, সে চাকরি পাচ্ছে টাকা দিয়ে। অন্য চাকরির ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ উঠছে। চাকরি পেয়ে সে তো চেষ্টা করবে সেই টাকা তুলতে। ফলে দুর্নীতি বাড়ছে।” ২০২২ সালের রিপোর্টে আর্থিক অপরাধ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা ড. ইসলামের। পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর মত, "পুলিশ রাজনৈতিক দলের নেতাদের নির্দেশে কাজ করে। অনুব্রত মণ্ডলের দেহরক্ষীর ভূমিকা দেখুন। জালিয়াতি কীভাবে বন্ধ হবে?”
লোভের ফাঁদে সর্বস্বান্ত
দারিদ্র্য, কর্মসংস্থানের অভাব প্রতারণার ঝোঁক বাড়াচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকের মত। এ ক্ষেত্রে মানুষের লোভও অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন শুভময়। বলেন, "লোভ চিরন্তন রিপু। এই লোভ আটকানো পরিণত গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব। এখন লটারি বেচাকেনা হঠাৎই বেড়েছে। সেটার কারণ ওই অর্থের লোভ। মানুষকে সঠিক আর্থিক দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের যা দায়িত্ব, তা তৃণমূল সরকার পালন করেনি বলেই জনমানসে ধারণা। ফলে মানুষকে প্রতারকরা সহজে বিপথে চালিত করতে পারছে।”