আমরা এখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি – ভুলটা কোথায়?
২৭ জুন ২০২৫শত শত বছর ধরে আমরা নানা জাতিগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শান্তির স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই ন্যায় ও দরকারি কাঠামোগত সংস্কারকে উপেক্ষা করেছি। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর আমরা ভাবলাম এবার হয়তো পৃথিবী সত্যিকার অর্থে যুদ্ধবিরোধী হতে পারবে। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েও দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধ তো থামেইনি, বরং তার ধরন পাল্টেছে, আরো আধুনিক হয়েছে। আর মূল সংকট একই জায়গায় রয়ে গেছে।
যদি বিংশ শতককে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে বিশ্বযুদ্ধ ও পারমাণবিক দ্বন্দ্বের বিচারে, তাহলে একবিংশ শতক যেন হয়ে উঠছে স্থায়ী অস্থিরতার যুগ, যা কেবল অস্ত্র দিয়ে নয়, এর এক পাল্লায় রয়েছে প্রযুক্তিতে মোড়ানো ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, আর অন্যদিকে রয়েছে মানসিকতার গভীর দৈনতা।
মজার ব্যাপার হলো, ইতিহাস কিন্তু আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু কেন যেন আমরা শিখি না।
১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফালিয়া চুক্তি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা করে। কিন্তু একই সঙ্গে এমন এক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে, যা যুদ্ধাপরাধ বা অন্যের সীমানা অতিক্রম করা আগ্রাসী রাষ্ট্রগুলোকে দায়ী করা প্রায় অসম্ভব করে তোলে।
বিংশ শতকের দিকে আসা যাক। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিয়েছে কত সহজে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, যখন কারো কারো জাতীয় আকাঙ্ক্ষা আন্তর্জাতিক সীমারেখাকে ছাড়িয়ে যায়। ‘লিগ অব নেশন্স' ব্যর্থ হয়েছিল ফ্যাসিবাদ থামাতে। পরে জাতিসংঘ নামে তাকে আরো কার্যকর করতে চাওয়া হয়েছিল। তবে ক্ষমতার রাজনীতির কাছে সে অচল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য বহুবার মানবিকতা বা শান্তির উদ্যোগে ‘আশ্চর্যজনকভাবে' ভেটো দিয়েছে। আর এখানেই লুকিয়ে আছে মূল ত্রুটি। যাদের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা, তারাই নিয়ম তৈরি করে, ভেঙে ফেলে, আবার প্রয়োজনে অমান্য করে।
শীতল যুদ্ধের দ্বিধাবিভক্ত বিশ্ব থেকে আজকের বহুমুখী বিভ্রান্ত বিশ্বে বড় শক্তিগুলো প্রায়ই নিজেদের আধিপত্যকে শান্তির উপর প্রাধান্য দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ক্রমশ চীন নিজেদের কৌশলগত স্বার্থে যুদ্ধ চালিয়েছে, সরকার পরিবর্তন করেছে, কিংবা শান্তি প্রক্রিয়া আটকে দিয়েছে। শান্তি অনেক সময়ই হয়ে উঠেছে একটি রাজনৈতিক কৌশল, মানুষের অধিকার নয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোই সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ চালিয়েছে বা বাধা দিয়েছে শান্তিপ্রক্রিয়ায়।
ইমানুয়েল কান্টের মতো আদর্শবাদীরা প্রজাতান্ত্রিক সরকার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ‘চিরস্থায়ী শান্তি'র স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ লেখক ও কূটনীতিক ই.এইচ. কার আরো প্র্যাগমেটিক। তিনি তার বই The Twenty Years' Crisis (১৯৩৯)-এ লিখেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধু সদিচ্ছার ভিত্তিতে চলে না। ‘রিয়েল পাওয়ার' বা প্রকৃত শক্তি নির্ধারণ করে শান্তির ভবিষ্যৎ। যদি তাই হয়, তাহলে শক্তির কাছে অবদমিত এই শান্তি কখনো মুখ দেখাবে কি?
একদিকে মালালা ইউসুফজাই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান শিক্ষার পক্ষে লড়াই করে, অন্যদিকে গোপনে ড্রোন হামলা চালানো হয়, যার কোনো গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নেই। একদিকে শান্তিরক্ষা মিশন, অন্যদিকে অস্ত্রচুক্তি ও কর্পোরেট যুদ্ধ ব্যবসা। আমরা ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়' বলে যাকে মহিমান্বিত করি, তা বলতে আসলে কি কিছু আছে? রাষ্ট্রগুলো তো এখনো নৈতিকতার চেয়ে স্বার্থে চালিত হয়।
এবার আসুন প্রযুক্তি প্রসঙ্গে। চাকা থেকে ড্রোন- নানা আবিষ্কারে আমরা নিজেরা নিজেদের পিঠ চাপড়েছি। আমরা ভেবেছিলাম এই প্রযুক্তি মানবজাতিকে এক করবে, রক্ষা করবে। বাস্তবে প্রযুক্তি যেন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র খুলে দিয়েছে। সাইবার হামলা, ড্রোন যুদ্ধ, এআইভিত্তিক নজরদারি, ডিজিটাল বিভাজন - সব মিলিয়ে যুদ্ধ হয়েছে আরো গোপন, আরো দ্রুত, আরো জটিল।
তথ্য প্রযুক্তি আর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাও শান্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব - এসব প্ল্যাটফর্ম এখন ঘৃণা, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়ানোর হাতিয়ার।
আমি আশার কথা বলতে পারছি না। কারণ, ‘বিশ্বব্যবস্থা' যে ভেঙে পড়েছে, তা দৃশ্যমান। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত - এসব প্রতিষ্ঠান কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটোর ক্ষমতা এসব সংস্থাকে নিরপেক্ষ হতে দেয় না।
আন্তর্জাতিক আইন মানে শক্তিশালীদের জন্য বিকল্প, দুর্বলদের জন্য জেল। এই বৈষম্য শুধু যুদ্ধকেই নয়, বিচারের ক্ষেত্রকেও অনিশ্চিত করে তোলে।
তাহলে কি শান্তি অসম্ভব? অসম্ভব নয়, তবে বর্তমান কাঠামোয় তা হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতিসংঘে সংস্কার। স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা সীমিত করার কথা বিবেচনায় নিতে হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরো গণতান্ত্রিক কাঠামো আনতে হবে।
প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক নীতিমালা প্রয়োজন। ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তি করা দরকার ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
তবে সবার আগে প্রয়োজন নিরাপত্তার সংজ্ঞা বদলানো। সামরিক সুরক্ষা নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তাই হওয়া উচিত নিরাপত্তার সংজ্ঞা। এ দিয়েই শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু পরিষ্কার আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। নেদাল্যান্ডসের হেগ-এ মাত্রই শেষ হওয়া ন্যাটো সম্মেলনে আমরা দেখেছি ট্রান্স আটলান্টিক রাষ্ট্রগুলো কেমন করে অস্ত্রের ঝনঝনানি করেছে। নিরাপত্তা বাজেট জিডিপির ৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
শেষ কথা, আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ আর আগের মতো সীমান্তে সীমাবদ্ধ নেই। যুদ্ধ এখন ডিজিটাল পরিসরে, মানুষের মনোজগতে, রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিতরে। অদৃশ্য কিন্তু বিধ্বংসী।
আমরা ব্যর্থ হচ্ছি, কারণ, শান্তিকে আমরা মনে করি একটা লক্ষ্য, কিন্তু বাস্তবে এটি একটি প্রক্রিয়া। শান্তির জন্য শুধু কূটনৈতিক চুক্তি নয়, দরকার ন্যায়বিচার, মানসিক নিরাপত্তা ও একটি বৈশ্বিক মানবতা, যা ক্ষমতার ঊর্ধ্বে।
সত্যিকারের শান্তি তখনই আসবে, যখন আমাদের প্রশ্ন ‘কে বেশি শক্তিশালী' হবে না, বরং হবে ‘কে বেশি মানবিক'।