আদিগঙ্গা: নদী, নাকি নর্দমা
নগরায়নের চাপে হারিয়ে গেছে বহু প্রাকৃতিক সম্পদ। বিলুপ্ত হয়েছে প্রচুর নদনদী। আদিগঙ্গা তেমনই এক বিলুপ্তপ্রায় নদী।
নালা নয়, নদী
লোহার ঝাঁঝরির নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া যে নোংরা জল ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সেটা একটা নদী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগরজীবনের কাছে হেরে যেতে থাকা এক নদীর অংশ।
মেট্রোর তলায় নদী
কলকাতার দক্ষিণ শহরতলীর কবি নজরুল মেট্রো স্টেশানের নীচ দিয়ে বয়ে চলা খালের পাশেই নজরে পড়বে এই লোহার সেতুর অবশিষ্টাংশ। গড়িয়া অঞ্চলের পুরনো মানুষজন এটাকে দোলাপোল নামেই চিনতেন। গঙ্গা নদী বইতো এককালে এই পথে। এই দোলাপোল সেই নদীপারানীর পথ।
ওলন্দাজ ইতিহাস
শোনা যায়, সরস্বতী-ভাগীরথীর মাঝখানে সাঁকরাইল থেকে বেতড় পর্যন্ত খালটি ছিল অত্যন্ত অগভীর। ভাগীরথীর প্রবাহপথে পণ্যবাহী জাহাজ নিয়ে যেতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল ওলন্দাজদের। তাই তারা সেই খালটিকেই কেটে আরো চওড়া করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। বাংলার তৎকালীন নবাব আলিবর্দি খাঁর সম্মতি নিয়ে খাল চওড়া করা হলো। নাম হল কাটাগঙ্গা। ওপরের ছবিতে আদিগঙ্গা এবং এখনকার গঙ্গা, দুইটিই দেখা যাচ্ছে।
ভাবনায় ভুল
কিন্তু এই কৃত্রিম সংযোগে ভাগীরথীর জল আদিগঙ্গায় এসে পৌঁছলো না। প্রাচীন নদীটি তো এতে মরলই, পাশাপাশি আদিগঙ্গার তীর ধরে গড়ে ওঠা জনপদ, জনবসতিরও বিপুল ক্ষতি হলো। ওপরের ছবিতে দইঘাট ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নোংরা নালাটিই হলো আদিগঙ্গা।
মনসামঙ্গলে আদিগঙ্গা
বিপ্রদাস পিপলাই-এর মনসাবিজয় কাব্যে পাওয়া যায়, দেবী চণ্ডীর পুজো দিয়ে সপ্তডিঙা ভাসিয়ে আদিগঙ্গা বেয়ে কালীঘাটে এসেছিলেন চাঁদসদাগর। ধনপতির বাণিজ্যযাত্রা আদিগঙ্গা ধরেই। এই নদীর তীরেই চেতলা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পিছন দিকেই এই কালীঘাট ব্রিজ।
নদীর দখল
অষ্টাদশ শতাব্দীতে আদিগঙ্গা, পুরনো কলকাতার অন্যতম বসতি গোবিন্দপুর গ্রামের দক্ষিণ সীমা নির্দেশ করত। তাই সেই সময় এই নদীর নামকরণ করা হয় গোবিন্দপুর খাঁড়ি। এডওয়ার্ড সারম্যান খননকাজ চালিয়ে এটির সংস্কার করেন বলে কিছুকালের জন্য এর নাম হয় সারম্যানের নালা। পুটিয়ারি অঞ্চলে নদীর এই অংশের ধারে বসেছে দৈত্যাকার জলের পাইপ। পরিবেশবিদদের মতে এভাবেই দখল হয়ে যাচ্ছে নদীগুলি।
খালের নাম আদিগঙ্গা
১৭৭৩ সালে কর্নেল উইলিয়াম টালি এই নালাটিকে আরও গভীর করে সার্কুলার খালের সঙ্গে যুক্ত করেন। তারপর এর নাম হয় ‘টালির নালা’। ১৭৭৫ সালে কর্নেল টালি আদিগঙ্গার সঙ্গে বিদ্যাধরী নদীর যোগ স্থাপন করেন। আদিগঙ্গার অনেকটা অংশকেই টালিনালা বলা হয়। ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে কুদঘাট অঞ্চলের মেট্রো স্টেশন। যার তলায় স্থবির নোংরা কালো জলই আসলে আদিগঙ্গা।
হারিয়ে গেছে নদী
গড়িয়া বাজারের কাছে লোহার ঝাঁঝরির নীচে নর্দমার পাইপের ভিতরে সমাধিপ্রাপ্ত নদীটিকে আবার খুঁজে পাওয়া গেল প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের কামালগাজী উড়ালপুলের নিচে। স্থানীয় মানুষদের অনেকেরই জানা নেই যে এটি একটি নদী। তাদের কাছে এটি আবর্জনা ফেলার জায়গা মাত্র।
চৈতন্যের আদিগঙ্গা
শ্রীচৈতন্যদেবের নীলাচল যাত্রাতেও রয়ে গেছে এই নদীর কথা। আদিগঙ্গার তীরে একজায়গায় তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে বসেছিলেন কিছুদিন। সেই জায়গাই আজ পরিচিত বৈষ্ণবঘাটা নামে। সেই বৈষ্ণবঘাটায় নদীর বর্তমান চেহারা দেখলে শিউরে উঠতে হয়।
নদীর উপর মেট্রোর থাম
গড়িয়া পর্যন্ত দক্ষিণে মেট্রোরেলের যে আট দশমিক পাঁচ কিলোমিটার পথ পরে সম্প্রসারণ করা হয়, সেটি পুরোপুরিই উড়াল পথে। এই উড়ালপথটি অনেকাংশেই আদিগঙ্গার উপরে অবস্থিত। সমাজকর্মীদের মতে, আদিগঙ্গার বুকের উপর মেট্রোরেলের থাম এই নদী শুকিয়ে যাওয়ার এক অন্যতম কারণ।
নদীর ধারে ভাগাড়
বারুইপুর যাওয়ার পথে যদিও নদীটি কিছু সময়ের জন্য নর্দমা অবস্থা থেকে মুক্তি পায়, তবে শাসন রোড আর কৃষ্ণমোহন হল্টের মধ্যবর্তী অঞ্চলের এই ভাগাড় নদীর জলকে আবার নর্দমায় পরিণত করে। স্থানীয় মানুষ এই নদীকে খাল হিসেবেই জানেন।
জয়া মিত্রের অভিমত
নদী বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকর্মী জয়া মিত্রের মতে, ''এইসব নদীর সঙ্গে মিলে এদেশের সমাজ হাজার বছর ধরে বাস করছে। অথচ দেশের প্রত্যেকটি সরকার নদীদের গুরুত্ব আর স্বভাবের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা করে নিজেদের খেয়াল মতো চলছে। সে জন্যই আজ এই নদীগুলির এমন অবস্থা।''
প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তি
বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রশাসন নিজের দায়টুকু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু মানুষের সচেতনতা সর্বাগ্রে কাম্য।
মুছে গেছে ইতিহাস
প্রবীণ কিছু মানুষের অনুভূতি-- পচা দুর্গন্ধময়, মজে যাওয়া নর্দমার মতো আদিগঙ্গার তীরে গিয়ে দাঁড়ালে বড় কষ্ট লাগে। এককালে এই নদীতে জোয়ারভাটা খেলতো। গঙ্গাপাড়ের কত ইতিহাস, কত ধর্মস্থান, মানুষেরই প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপে মুছে গেছে আজ।