‘আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে নারী নির্যাতনের প্রবণতা কমবে'
২১ মার্চ ২০২৫এসব আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে নারী নির্যাতনের প্রবণতা কমে যাবে বলেও মনে করেন তিনি৷ ডিডাব্লিউর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন পুলিশ কর্মকর্তা ইয়াসমিন৷
ডয়চে ভেলে: উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে নারী ও শিশুরা নির্যাতনের কোন ধরনের সমস্যা নিয়ে বেশি আসেন?
মোছা. ফারহানা ইয়াসমিন: উইমেন সাপোর্ট সেন্টারে কয়েকভাবে ভিকটিমরা আসতে পারেন৷ পারিবারিক নির্যাতন হলে বা স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে তারা আমাদের কাছে সমাধানের জন্য আসেন৷ তারা মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য বলেন৷ আরেকভাবে আসে থানায় জিডি হওয়ার পর হারিয়ে যাওয়া শিশুরা৷ আরেকভাবে আসে সেটা হলো, নারী নির্যাতনের ভিকটিম কোনো জেলা থেকে এসেছেন, কিন্তু ঢাকায় তার থাকার জায়গা নেই, বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন৷ তখন আমরা তাকে এখানে রাখি ওই ঘটনার মামলার ভিত্তিতে৷ আইনগত প্রক্রিয়া মেনে আমরা তাদের রাখি৷ মূলত নারী নির্যাতনের যে কোনো ধরনের শিকার নারী ও শিশুরা আমাদের এখানে আশ্রয় পান৷ তবে নারী সাক্ষীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে আমরা তাদের এখানে রাখি৷
নির্যাতন, ধর্ষণ, হয়রানির মামলা করতে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ভুক্তভোগীদের?
জেলা পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, নারী নির্যাতনের অধিকাংশ মামলা যৌতুকের কারণে হয়৷ আমার অভিজ্ঞতা এইসব মামলার ৯০ ভাগই মিথ্যা৷ কোনো কারণে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে যৌতুকের মামলাটা করে দিচ্ছে৷ ধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখেছি, মেয়েটা প্রেম করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে৷ কিন্তু ছেলেটা বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না, তখন মামলাটা করে দিচ্ছে৷ আবার সত্যিকারের ঘটনাও ঘটছে৷ মাদ্রাসায় ছোট বাচ্চারা বলাৎকারের শিকার হয়৷ ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যে ধর্ষণের মামলা হয় সেগুলো শতভাগই ঠিক৷ থানায় গিয়ে নারীরা যে পরিস্থিতিতে পড়ত সেখানে আমি দেখেছি, আগে থানাগুলোতে অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ সদস্য৷ ফলে তারা অভিযোগ করতে গিয়ে শেকি ফিল করতো৷ তখন তাকে আবার সেই ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হতো৷ পুলিশ সদস্যরা প্রশ্ন করলে মেয়েটা আপসেট ফিল করতো৷ পরবর্তীতে থানাগুলোতে নারী-শিশু হেল্প ডেস্ক করা হয়েছে৷ এই কথা চিন্তা করেই যে, ভিকটিমরা যেন নিরাপদে, নির্বিঘ্নে তাদের অভিযোগটা করতে পারে৷ এই ডেস্কে এসআই পদমর্যাদার একজন নারী পুলিশ সদস্য থাকার কথা৷ কিন্তু ওই পরিমাণ নারী এসআই তো নেই৷ ফলে সব থানায় দেওয়া সম্ভব হয়নি৷ একটা মেয়ে তো এই ধরনের ঘটনার পর ট্রমাটাইজড থাকে৷ তারপর সে মামলা করতে গিয়ে এতগুলো পুরুষ সদস্যের মধ্যে আবার ঘটনাটা বলতে হয়৷ কোনো মেয়ে খুব বেশি সাহসি এবং পাবলিকলি কথা বলার অভ্যাস না থাকলে ঘটনা বলাটা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়৷ তখন দেখা যায় সে, অনেক কিছু লুকায়, অনেক কিছু বলতে চায় না৷ কিন্তু এই বিষয়গুলো তো প্রমাণ সাপেক্ষ৷ সে ব্যাথা পেয়েছে কিনা? আঘাত পেয়েছে কিনা? মেডিকেল করতে গেলেও দেখা যায় তাকে একই ধরনের প্রসিডিওরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ ফলে অভিজ্ঞতায় তার সঙ্গে যেন একই ঘটনা বারবার ঘটে৷ একবার সত্যিকারে হয়েছে, একবার থানায় এসে বলতে হয়, তখন সে ট্রমাটাইজড হয়৷ আবার মেডিকেল করতে গিয়ে আরেকবার এটা সে মনে করে৷ তখন আরেকবার ট্রমাটাইজড হয়৷ বিচারে গিয়েও তাকে এই কথাগুলো আবার বলতে হয়৷ এগুলো করতে গিয়ে আশপাশের লোকজন বিষয়টি জানে এবং সামাজিকভাবে সে হেয় হয়৷ বিষয়টা এমন হয় যে, দোষটা বুঝি তার৷ আমাদের সোসাইটির যে ট্যাবু তাতে ভিকটিমের দিকেই আঙুল তোলে৷
যারা এই সমস্যাগুলো নিয়ে আসেন তারা কি সবসময় পুলিশের সাহায্য পান?
আমি যেসব জায়গায় কাজ করেছি, সেখানে দেওয়ার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু সবারটা তো বলতে পারবো না৷ কারণ এটা নিয়ে তো আমি কোনো রিসার্চ করিনি৷ আমার কর্মস্থলগুলোতে নারীদের কোনো বিষয় এলে আমাকেই দেওয়া হতো৷ তখন আমি তাকে ন্যায়বিচার দেওয়ার শতভাগ চেষ্টা করেছি৷ আমাদের তো পুরুষশাসিত সমাজ৷ পুলিশ তো এই সমাজেরই অংশ৷ সোসাইটির মানসিকতা যেমন, পুলিশের মানসিকতাও হয়ত তেমন৷
ভুক্তভোগীরা কতটা মানসিক সহায়তা পান পুলিশের কাছ থেকে?
পুলিশের কাছ থেকে কতটুকু পায় সেটা বলতে পারব না, তবে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে পুরোপুরি পায় সেটা আমি বলতে পারি৷ এখানে মানসিক চিকিৎসকদের দিয়েও কাউন্সিলিং করানো হয়৷ এখানে কিন্তু সবাই নারী৷ এমনকি এনজিও কর্মীরাও নারী৷ চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ সবাই নারী৷ এখানে কেউ আসলে তাকে নতুন করে আর কোনো ট্রমায় পড়তে হয় না বলে আমার বিশ্বাস৷ যদিও আমি এখানে দুই মাস আগে যোগ দিয়েছি৷
রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে নারীদের সুরক্ষায়-নিরাপত্তার কী কী ব্যবস্থা আছে?
খুবই অপ্রতুল আসলে৷ আমি এখানে আসার পর বিভিন্ন স্কুল-কলেজে নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করছি৷ ওদের সচেতন করার চেষ্টা করছি৷ আমার মনে হয়েছে, মেয়েদের সচেতন করার মানে তোমরা এভাবে চলো, ওভাবে চলো৷ কিন্তু এই সচেতনতাটা আরও বড় পরিসরে হওয়া উচিত৷ স্কুল পর্যায় থেকেই ছেলে শিশুদের এ ব্যাপারে সচেতন করা উচিত৷ আমাদের ছেলেদের নিয়েও বসা উচিত৷ ছেলেদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই৷ এখানে দেড় হাজার মানুষের জন্য একজন পুলিশ৷ পুলিশ পাহাড়া দিয়ে তো এগুলো কন্ট্রোল করা সম্ভব না৷ আমি জাপানে পড়াশোনা করেছি৷ ছিলাম আড়াই বছরের মতো৷ কিন্তু কোনোদিন দেখিনি কোনো ছেলে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে হাঁটে৷ রাত আড়াইটা বা তিনটার দিকেও কোনো নারী রাস্তায় চলতে অনিরাপদ বোধ করে না৷ কিন্তু আমাদের দেশে এটা কল্পনাও করা যায় না৷ ওরা তো আরও শর্ট পোশাকে ঘোরাফেরা করে৷ কিন্তু আমাদের দেশে কোনো ইভটিজিং হলেই বলা হয়, নারী পর্দা করেনি, ওভাবে চলাফেরা করেছে৷ যে কারণে এটা হয়েছে৷ আঙুল সবসময় মেয়েদের দিকেই তোলা হয়৷ ধর্মীয় অনুশাসনের কথাও যদি বলি, ছেলেদের চোখের পর্দা করে চলার কথা, তারা তো সেটা মানছে না৷ কোনো কিছুই ছেলেদের শেখানো হচ্ছে না৷ সবকিছু শুধু মেয়েদেরই বলা হয়৷ এভাবে চললে এটা কন্ট্রোল করা কঠিনই৷ ছেলেদেরকেই আগে সচেতন করতে হবে৷
নারীরা সামাজিক মাধ্যমে অনেক বেশি হয়রানির শিকার হন৷ তারা পুলিশের কাছ থেকে কতটা সহযোগিতা পান?
সাইবার ইউনিটে আমার দুই মাস কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, সাইবারে অনেক বেশি অভিযোগ এখন আসছে৷ ফেসবুকে পরিচয় হয়েছে, ছবি চালাচালি হয়েছে, তারপর মেসেজ আদান-প্রদান হয়েছে তারপর ছেলেটা এগুলোকে পুঁজি করে মেয়েটাকে ব্ল্যাকমেইল করছে৷ তার ছবি বা নম্বর ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ তাকে কলগার্ল হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে৷ তারপর কোথাও নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে সেটা আত্মীয়স্বজনের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ সাইবার সংক্রান্ত অভিযোগগুলো এখন বাস্তব ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি৷ এটা যদি কন্ট্রোল না করা যায় তাহলে আগামী এক বছরের মধ্যে এটা মহামারি আকার ধারণ করবে৷ এগুলো তদন্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতাও তো কম৷ বাস্তবে তো কিছু হলে অপরাধীকে ধরা যায়৷ কিন্তু এখানে তো ধরাও যাচ্ছে না৷ কে পোস্ট দিল, সেখান থেকে কোথায় ছড়িয়ে পড়ল সেটা বের করাও কঠিন৷ এই কাজটা তো অনেক বেশি টেকনোলজি বেজড৷ এমন পরিস্থিতিতে মেয়েটা আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে৷ ছেলেদের সচেতন করার পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও সচেতন করতে হবে যেন, তারা মেয়েটার অভিযোগটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেন৷ এখনও করেন, ভালোই করেন৷ তবে আরও বেশি করা প্রয়োজন৷
বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজের সময় নারীদের নিয়ে নানা ধরনের অবমাননাকর কথা বলা হয়৷ এমন পরিস্থিতিতে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নেন?
আমার কাছে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা আসেনি৷ ফলে আমাকে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়নি৷ কোনো হুজুর ওয়াজে এমন কিছু বলেছে, আমি যেন ব্যবস্থা নেই, এমন কোনো পরিস্থিতি আমার ক্ষেত্রে হয়নি৷
নারীদের সুরক্ষায় আর কী কী সহযোগিতা করতে পারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী? আইনে কী ধরনের সহযোগিতার সুযোগ আছে?
আইন তো অনেক শক্তই আছে৷ আইনগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে৷ অ্যাসিড নিক্ষেপ আইনটার প্রয়োগ হওয়ার কারণে অ্যাসিডের ঘটনা অনেক কমে গেছে৷ একইভাবে নারী নির্যাতন আইনটার প্রয়োগ হওয়ার কারণে যৌতুক প্রথা অনেক কমে গেছে৷ বিলোপই হয়ে গেছে বলতে হবে৷ এভাবে যদি আমরা আইনটা প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে নারী নির্যাতনের এই প্রবণতাও কমে যাবে৷
নারীদের অভিযোগ করার জন্য পুলিশের যে অ্যাপ রয়েছে সেখানে আসা অভিযোগগুলো কতটা খতিয়ে দেখা হয়?
খতিয়ে দেখা হয় আসলে৷ কিন্তু সংখ্যাটা যদি অনেক বেশি হয় তখন হয়ত লোকবলের অভাবে কিছুটা ঘাটতি হয়৷ কিন্তু পুলিশের গুরুত্ব কিন্তু সময় অনুযায়ী বাড়ে বা কমে৷ যেমন এখন ধর্ষণের ইস্যুটা চর্চিত হচ্ছে, ফলে এটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে৷ এভাবে হয়ত এটাকে কন্ট্রোল করার পর আরেকটা ইস্যু চলে আসে৷ তখন সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়৷ আমি নারী হিসেবে সবসময় এটাকে সবচেয়ে গুরুত্বের জায়গাতেই রাখি৷
গত এক বছরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে কতজন নারীকে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে?
এই সংখ্যাটা এখনই বলা মুশকিল৷ কারণ আমি দুই-আড়াইমাস আগে এখানে এসেছি৷ আমি এসে যেটা দেখেছি, আগেও এমন হয়েছে বলে শুনেছি যে, মাসে ৪৫ থেকে ৫০টি মামলা এখানে আসে৷ এখানে কিন্তু সরাসরি কোনো অভিযোগের সুযোগ নেই৷ থানা থেকে মাসে ৩০-৩৫টি মামলা পাঠানো হয়৷ এর বাইরে আদালত থেকেও ১৫-২০টি জিআর-সিআর মামলা পাঠানো হয়৷ এর বাইরে থানা থেকে নারী ভিকটিম আসে, হারিয়ে যাওয়া শিশু আসে৷ মামলার বাইরেও প্রতি মাসে ৩০-৪০ জন নারী শিশু এখানে সহযোগিতা নেন৷
নারী নির্যাতনের মামলাগুলোতে সাক্ষীদের কতটা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়?
কোন সাক্ষী অনিরাপদ বোধ করলে তাকে আমরা এখানে রাখি, সহযোগিতা দেই৷ কেউ ঝুঁকি অনুভব করলে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের এখানে আশ্রয় নিতে পারে৷ তবে সাক্ষীদের এমন ঝামেলা খুব একটা দেখি না৷ খুব বেশি ঝামেলা হয় না৷ যে ঝামেলা ফিল করে সে সাক্ষী হতেই চায় না৷ জোর করে তো কাউকে সাক্ষী বানানো যায় না৷ যারা স্বেচ্ছায় হয় তাদেরই বানানো হয়৷