অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে জনবিন্যাস মিশন, ঘোষণা মোদীর
১৫ আগস্ট ২০২৫শুক্রবার ভারতের ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা তুললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপর তিনি তার ভাষণে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন। তিনি রীতিমতো গুরুত্ব দেন অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টিকে। জনবিন্যাস মিশনের ঘোষণা করেন ।
অনুপ্রবেশকারী নিয়ে
মোদী বলেছেন, ''আমি পুরো দেশকে একটা উদ্বেগজনক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চাই। খুব পরিকল্পনামাফিক চিন্তাভাবনা করে আমাদের বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত করা হয়েছে। এর ফলে দেশের জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে। নতুন সংকটের বীজ বপন করা হয়েছে। অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের দেশের যুবকদের জীবিকা ছিনিয়ে নিচ্ছে। তারা আমাদের মা-বোনকে টার্গেট করছে। তারা জনজাতিদের ভুল বুঝিয়ে তাদের জমি দখল করছে। এসব সহ্য করা হবে না।''
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ''সীমান্ত এলাকায় জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে, এটা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি। কোনো দেশ অনুপ্রবেশকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে না। তাহলে আমরা কী করে করব? আমাদের পূর্বজরা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব হলো, এই ধরনের কার্যকলাপ অনুমোদন না করা। লালকেল্লা থেকে আমি তাই ঘোষণা করতে চাই, একটা উচ্চস্তরীয় জনবিন্যাস মিশন শুরু করা হবে। এই মিশন ভারতের সামনে যে বিপদ রয়েছে, তার মোকাবিলা করবে।''
দিওয়ালির উপহার ও জিএসটি সংস্কার
প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ''এবারের দিওয়ালির আমি আপনাদের জন্য ডবল দিওয়ালি করে দেব। এই দিওয়ালিতে দেশের নাগরিকরা একটা বিশাল উপহার পাবেন। আমরা জিএসটি সংস্কার করছি।''
মোদী জানিয়েছেন, ''জিএসটি চালুর আট বছর পর পরবর্তী সংস্কার নিয়ে আমরা উচ্চস্তরের কমিটি গঠন করছি। রাজ্যগুলির সঙ্গেও আলোচনা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যেসব নিত্যপণ্য ব্যবহার করেন, তার উপর ধার্য করা কর কমে যাবে। ফলে প্রতিদিন যে সব জিনিস ব্যবহার করা হয় তার দাম কমবে। আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।''
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,''জিএসটি পালন করার পদ্ধতি সরল হবে, দ্রুত রিফান্ড পাওয়া যাবে, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলি উপকৃত হবে।''
কৃষক, মৎস্যজীবী, ডেয়ারি শিল্প
মোদী বলেছেন, ''ভারত কখনই এমন কোনো নীতি নেবে না, যার ফলে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের কৃষক, মৎস্যজীবী ও ডেয়ারির সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। তার ঘোষণা, যদি কোনো শক্তি বা কোনো ব্যক্তি এরকম নীতি চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে আমি দেওয়াল হয়ে তার সামনে দাঁড়াব।''
প্রধানমন্ত্রী কোনো নাম করেননি। তবে তিনি দেশের কৃষক, মৎস্যজীবী ও ডেয়ারির সঙ্গে যুক্তদের পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকেও বার্তা দিয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কারণ, অ্যামেরিকা চেয়েছিল, ভারত শুল্ক কম করে কৃষি, ডেয়ারি ও মাছের রপ্তানির ক্ষেত্রে মার্কিন সংস্থাগুলির সুবিধা করে দিক। ভারত এই দাবি মানেনি বলেই বাণিজ্য চুক্তি হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে
নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ''ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রক্ত ও জল পাশাপাশি বইতে পারে না। আমরা জল ধরে রাখব। আমাদের ন্যায্য পাওনার জল কৃষকদের দেব। কৃষকদের স্বার্থরক্ষা করব। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আমরা সমঝোতা করব না।''
অপারেশন সিন্দুর বা সিঁদুর নিয়ে তিনি বলেছেন, ''আমরা সেনাবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। তারাই ঠিক করেছে, কখন, কোথায়, কী করতে হবে।''
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ''ভারত এবার যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরি করবে।’’ তিনি ঘোষণা করেছেন, এই বছরের শেষেই ভারত তার প্রথম সেমিকনডাক্টার চিপ বাজারে নিয়ে আসবে।
আরএসএস নিয়ে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ''আজ থেকে একশ বছর আগে একটা সংগঠনের জন্ম হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। একশ বছর ধরে তারা দেশের সেবা করেছে, এটা গৌরবের বিষয়। রাষ্ট্রনির্মাণ ও দেশের কল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে আরএসএস কর্মীরা তাদের জীবন সমর্পণ করেছে। তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও। আমি লালকেল্লার প্রাকার থেকে সব স্বয়ংসেবককে স্মরণ করছি।''
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশ বলেছেন, ''প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ৭৫তম জন্মদিনের আগে লালকেল্লার প্রাকার থেকে আরএসএসকে খুশি করার মরিয়া চেষ্টা করেছেন। তিনি এখন সম্পূর্ণভাবে মোহন ভাগবতের করুণার উপর আছেন। সেপ্টেম্বরের পরে তিনি আর পদে থাকবেন কিনা তা ভাগবতের উপরেই নির্ভর করছে। তিনি যেভাবে স্বাধীনতা দিবসের দিনটিকে নিজের ও সংগঠনের সুবিধার জন্য লাগিয়েছেন, তা গণতান্ত্রিক চরিত্রের বিরোধী। তিনি যা বলেছেন, তাতে দেশের সংবিধানবর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের ধারণাতে আঘাত লেগেছে।''
কংগ্রেসের আরেক সাংসদ মানিকরাম ঠাকুর বলেছেন, ''আরএসএস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে কোনো লড়াই করেনি। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি। স্বাধীনতা দিবসে তাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করাটা ঠিক হয়নি।''
আরজেডি নেতা মনোজ ঝা বার্তাসংস্থা এএনআই-কে বলেছেন, ''গত ১১ বছরে প্রধানমন্ত্রী যতবারই লালকেল্লার প্রাকার থেকে ভাষণ দিয়েছেন, ততবারই আমাদের আশা ছিল, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো কথা বলবেন, কোনো পক্ষপাত দেখাবেন না। প্রতিবারই তিনি আমাদের হতাশ করেছেন।''
মনোজ বলেছেন, ''আরএসএসের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। তারা একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা, প্রধানমন্ত্রীর উচিত স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ভূমিকার মূল্য়ায়ন করা। আজ আমরা এটা বুঝতে পারলাম না প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক ভাষণ দিচ্ছেন নাকি স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিচ্ছেন।''
সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব বলেছেন, সংঘ পরিবারের পথ ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজবাদী পথ নয়। ওরা মুখে বলে ওরা স্বদেশি, কিন্তু মনে মনে ওরা বিদেশি।
'জিএসটি-র সংস্কার দরকার'
জিএসটি বিশেষজ্ঞ এবং এক্সাইজ ও কাস্টমস বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এই ঘোষণা প্রত্যাশিত ছিল। বিস্তারিতভাবে পদক্ষেপগুলো জানলে বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারব। তবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনিতে ২০১৭ সাল থেকে চালু হওয়ার পর থেকেই জিএসটির সমানে সংস্কার চলছে। গণতন্ত্রে রাজ্য ও কেন্দ্র মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে সকলকে এক মঞ্চে আনতে সময় লাগে, তাই একটু দেরি হয়।''
জিএসটি-র উপর একাধিক বইয়ের লেখক সুমিত দত্ত মজুমদারের মতে ''জিএসটিতে এখন পাঁচটি হার আছে। শূন্য, পাঁচ, ১২, ১৮ ও ২৮ শতাংশ। এখন ১২ ও ১৮ শতাংশ নিয়ে একটা সমস্যা আছে। যে পণ্যগুলি ১২ ও ১৮ শতাংশে রাখা হয়েছে, তার অনেকগুলির মধ্যে ফারাক বেশি নেই। তাই আমার মতো অনেকেই মনে করেন, ১২ ও ১৮ এক করা হোক। কর যুক্তিপূর্ণ করা হোক। ২৮ শতাংশ খুব দামি জিনিসের উপর আছে, তা সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে না। ফলে তা নিয়ে সমস্যা নেই। ১২ ও ১৮ শতাংশকে মিশিয়ে মাঝামাঝি একটা ১৪ শতাংশ করা যেতে পারে। তাহলে বেশ কিছু জিনিসের দাম কমবে।''
তার মতে, ''জিএসটি আসার পর দুর্নীতির সুযোগ কমে গেছে। তবে আমাদের ছোট ও মাঝারি ক্ষেত্রর কথা ভাবতে হবে। এখন সব দেশে ছোট ও মাঝারি শিল্প একটা ছাড় পায়। ৮০ লাখ থেকে এক কোটির টার্নওভার হলে কর দিতে হয় না। আমরা প্রথমে এই সীমা রাখি ২০ লাখ। তারপর তা বাড়িয়ে ৪০ লাখ করা হয়। আবার তার মধ্যে রিভার্স চার্জের মতো কিছু শর্ত রাখা হয়েছিল, যার ফলে ছোট শিল্প মার খেয়েছে। ছোট ও মাঝারি শিল্পের ছাড়ের সীমা বাড়ানো দরকার। প্রধানমন্ত্রী ভালো পদক্ষেপ নিয়েছেন। নিঃসন্দেহে জিএসটির রেশনালাইজেশন দরকার।''
জিএইচ/এসজি(প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, এএনআই, পিটিআই)