অগাস্টে আন্দোলনের ত্রিফলা, কিন্তু প্রভাব পড়বে কি
৭ জুলাই ২০২৫পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে বছরখানেকের মধ্যে। বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে রেখে আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়াতে চাইছে বিরোধীরা।
আন্দোলনের ঘোষণা
চলতি মাসে দক্ষিণ কলকাতার আইন কলেজে এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে পথে নেমেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এরই মধ্যে আগামী ৯ আগস্ট আরজি করে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার এক বছর পূর্তি হচ্ছে। সেই উপলক্ষে একাধিক কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়েছে।
৯ আগস্ট নবান্ন অভিযানের ডাক দেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আরজি করে নিহত চিকিৎসকের বাড়িতে যান। সেখানে চিকিৎসকের বাবা নবান্ন অভিযানের কথা বলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে বিজেপি নেতা শুভেন্দুর ঘোষণা, রাজনৈতিক দলের পতাকা ছাড়া সেদিন নবান্ন অভিযান হবে।
আর জি কর আন্দোলন ঘিরে তৈরি হওয়া অভয়া মঞ্চ কালীঘাট অভিযানের ডাক দিয়েছে একই তারিখে। দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। ৯ আগস্ট কালীঘাট চলো কর্মসূচি নিয়েছে অভয়া মঞ্চ।
গত বছরে ১৪ই আগস্ট নারী সুরক্ষার দাবিতে রাত দখলের কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। কলকাতার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা শহরে লাখো নারী মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই কর্মসূচির এক বছর পূর্তি হতে চলেছে। তাই এই স্বাধীনতা দিবসের ঠিক একদিন আগে ফের একই কর্মসূচি ডাক দেয়া হয়েছে।
অতীতের আন্দোলন
আরজি করে চিকিৎসকের হত্যার পরে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক উদ্যোগে একের পর এক কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। জুনিয়র চিকিৎসকরা দিনের পর দিন অবস্থান ও অনশন করেছেন ধর্মতলায়। বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিংয়ে অবস্থান করেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজ নামে হঠাৎ প্রকাশ্যে আসা একটি সংগঠন নবান্ন অভিযানের ডাক দেয় গত বছর এই অভিযান ঘিরে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই অভিযানের শরিক হয়েছিল সরকারি কর্মীদের সংগঠন সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ।
রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা তাদের বকেয়া মহার্ঘভাতার দাবিতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি পথে নেমে প্রতিবাদ করেছেন, লাগাতার ধরনা অবস্থান করেছেন। তাদের আন্দোলন এখনো চলছে।
আরজি করের পরে সবচেয়ে বড় আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল নিয়োগ দুর্নীতি। সুপ্রিম কোর্টের রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে যায়। এ নিয়ে চাকরিহারারা মাঝেমধ্যেই মিছিল করছেন শহর থেকে জেলায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আগামী বছর পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ।
গত এপ্রিলে ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদে হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল। ঘরে ঢুকে দুই গ্রামবাসীকে হত্যা করে উত্তেজিত জনতা। এ নিয়ে বিজেপি হিন্দু শহিদ দিবস পালন করতে রাস্তায় নেমেছিল। এছাড়া বারবার বিজেপি সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলে রাস্তায় নেমেছে।
নির্বাচনের ফল
আরজি কর কেন্দ্রিক উত্তাল আন্দোলনের পরপরই রাজ্যের ছয়টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়েছিল। উত্তর থেকে দক্ষিণে রাজ্যের সব প্রান্তে জয়লাভ করেছিল তৃণমূল। ১৩ নভেম্বর ভোটগ্রহণ করা হয়, যখন আরজি কর আন্দোলনের রেশ কাটেনি।
কোচবিহারের সিতাই, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া ও নৈহাটি, বাঁকুড়ার তালডাংরা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর আসনে উপনির্বাচন হয়। পাঁচটি আসন ধরে রাখার পাশাপাশি মাদারিহাট বিজেপির হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল।
ওয়াকফ নিয়ে অশান্তির পরে গত মাসে নদিয়ার কালীগঞ্জে উপনির্বাচন হয়। সংখ্যাগুরুর ভোটকে একজোট করার ডাক দিয়ে নির্বাচনে ঝাঁপিয়েছিল বিজেপি। সংখ্যালঘু প্রধান হলেও এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট কমে গিয়েছে। ব্যবধান বাড়িয়ে জিতেছে তৃণমূল।
আরজি কর আন্দোলনের মতো এত ব্যাপক অরাজনৈতিক জন বিক্ষোভ স্মরণাতীত সময় পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি। তা সত্ত্বেও যদি নির্বাচনে কোনো প্রভাব না পড়ে, তাহলে আগামী বছরের প্রথমার্ধে হতে চলা রাজ্য বিধানসভা ভোটে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে এ ধরনের আন্দোলন? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, গ্রামে পৌঁছনো না গেলে আন্দোলনের প্রভাব ভোটবাক্সে দেখা যাবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শুভময় মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "শহরের আন্দোলন গ্রামের মানুষের কাছে কতটা পৌঁছতে পারছে, এই বিষয়টা খুব একটা পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে আন্দোলন গ্রামে পৌঁছতে পারছে না, এটা ধরে নিয়ে শাসক দল যদি ভাবতে শুরু করে এটাকে পাত্তাই দেব না, তারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিচ্ছে, সংখ্যালঘু ভোট তাদের দখলে আছে, সেক্ষেত্রে বিষয়টা অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেখতে হবে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমীকরণগুলি কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখনও সেটা বলার সময় আসেনি। গ্রামবাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের জমি একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এমন নয়। তবে নির্বাচন একদিনে ঘুরে যেতে পারে। ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে যে প্রচার, তার ফলে মানুষের ভাবনা দ্রুত পরিবর্তনশীল। যদি বিরোধীদের আন্দোলন একজোট না হয়, যার সম্ভাবনা যথেষ্ট, যেহেতু বিজেপি ও বামেদের বোঝাপড়ায় আসা খুব শক্ত, তাহলে শাসকদের বেগ দেয়া কঠিন। সুতরাং রাজ্যের যে ভোট রাজনীতি, তাতে যে বিপুল পরিবর্তন হবে, সেটা আপাতত বোঝা যাচ্ছে না। এখনই ভোট হলে বড় পরিবর্তন কতটা হত, সেটা বলা শক্ত। বলা যেতে পারে, সেই সম্ভাবনা খুব বেশি এখনই নয়।"
সিনিয়র চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "আন্দোলন হলেই ভোটে তার প্রভাব পড়বে, এভাবে বলা যায় না। তবে শহরের মতো গ্রামে আন্দোলনের প্রভাব ততটা পড়েনি, এ কথাটা সত্যি। যদিও অনেক জেলা শহরে ব্যাপক প্রতিবাদ দেখা গিয়েছে। নারী সুরক্ষার দাবিতে আবার এই আন্দোলনকে সংগঠিত করার চেষ্টা চলছে। এর পিছনে ভোটের ভাবনা নেই, এটা অরাজনৈতিক নাগরিক উদ্যোগ।"
এই আন্দোলন কেন গ্রামকে ছুঁতে পারছে না? কারণ ব্যাখ্যা করে সিনিয়র সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই আন্দোলন শুধু শহর নয়, একেবারে কলকাতা কেন্দ্রিক হয়ে রয়ে গিয়েছে। এটা আন্দোলনের নেতৃত্বের ভুল পদক্ষেপের ফলেই হয়েছে। সে কারণে আরজিকর আন্দোলনের পরে ছটি বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল জয়ী হয়েছিল। এরপরে চিকিৎসক আন্দোলনের মুখ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন যখন গ্রামে পোস্টিং নেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা দেখান, তখন তারা গ্রামের মানুষের কাছ থেকে আরো দূরে সরে গিয়েছেন। যে ইস্যুগুলি আন্দোলনের নেতারা তুলে ধরতে চাইছেন, সেগুলি ভীষণ শহুরে ও এলিট। তাই ক্যানিংয়ের সাবির শেখকে হরিয়ানায় গোরক্ষকরা যখন পিটিয়ে মারে, তখন এদের দেখা যায় না। বাঙালি শ্রমিকদের যখন বিএসএফ পুশব্যাক করে, তখনও এরা কিছু বলেন না। তাই প্রান্তিক মানুষের এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।"
আরো একাধিক ফ্যাক্টর রয়েছে বিরোধীদের ব্যর্থতা ও শাসকের নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন,
"মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন সিপিএম বিরোধী সব ভোট এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল। কিন্তু এখন বিরোধী ভোট বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস শিবিরে বিভক্ত। এছাড়া বিজেপির কারণে সংখ্যালঘু ভোটের প্রায় সবটাই চলে গিয়েছে তৃণমূলের দিকে। উল্টো দিকে এ রাজ্যে যদি হিন্দু ভোটের অধিকাংশ বিজেপির দিকে যেত, তাহলে সরকার ও প্রধান বিরোধীর মধ্যে ব্যবধান ঘুচে যেত। কিন্তু আমাদের রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির পরম্পরা আছে। ফলে হিন্দু প্রান্তিক মানুষের সব ভোট বিজেপি পাচ্ছে না। এর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সামাজিক প্রকল্পগুলি বিপুল সাড়া ফেলেছে। উপভোক্তারা মনে করেন, মমতা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে এটুকু সুবিধাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। একই সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর ক্যারিশমা এবং শাসক দলের সাংগঠনিক ক্ষমতার কথা বলতে হয়। অনেক অনাচার, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হলেও মূলত এইসব কারণে তৃণমূল ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে।"